বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার গতিধারা

মুকুল কান্তি ত্রিপুরা


কথায় আছে, সাহিত্য একটি সমাজের দর্পনস্বরূপ। একটি সমাজের বাস্তবতার নিদারুন চিত্র এবং আবেগ-অনুভূতির প্রতিফলন এই সাহিত্যের মাধ্যমে ফুটে উঠে। তাই বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। এই সাহিত্যগুলোতে ফুটে উঠেছে ত্রিপুরা জাতির জনজীবন তথা আবেগ-অনুভূতির স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। তাই বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা এখন সময়ের দাবী, যে ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছিল বিংশ শতকে। মূলত বিংশ শতকে ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রয়াসই ত্রিপুরা সাহিত্যের মূল প্রাণ। এক ফালি রোদ আর এক ফালি বৃষ্টি নিয়েই ত্রিপুরা সাহিত্য জীবনের পথচলা। কখনও আঁধার আবার কখনওবা আলোর লুকোচুরি খেলা যেন ত্রিপুরা সাহিত্য চর্চার গতিধারাকে ফেলে দিয়েছে এক গোলকধাঁধায়। আর তারই অনুসন্ধানের ফসল হিসেবে আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। 

মূলত, যে সাহিত্য ত্রিপুরা ভাষায় রচিত হয় তাকেই আমরা ত্রিপুরা সাহিত্য বা ত্রিপুরা ককরাবাই বলে থাকি। যেমন- ত্রিপুরা ভাষায় ককফমে (ধাঁধা), কারাকক/ককদুমা(রূপকথা), ককলপ (কবিতা), ককমা (ব্যাকরণ), থুঙনুক (নাটক), কথমা (গল্প), ককবাখাল (প্রবন্ধ) ইত্যাদি। তবে বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের এই সাহিত্য চর্চা একদিনের সৃষ্টি নয়। বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যের রয়েছে স্মরণাতীতকালের ইতিহাস। কেননা ত্রিপুরা কথ্য সাহিত্যগুলো লোকমুখে যুগে যুগে চর্চা হয়ে আসছে।  এমনকি ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের ইতিহাসগ্রন্থও এই ভাষায় রচিত ছিল বলে জানা যায়। যদিও বর্তমানে ত্রিপুরা ভাষায় রচিত এই গ্রন্থটি দুর্লভই বলতে হয়।

আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় রচিত সাহিত্যেকে প্রধাণত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- 

১. সাজাকজাক ককরাবাই যাকে বাংলায় বলা হয় কথ্য সাহিত্য  ও 

২. সুইজাকজাক ককরাবাই যাকে বাংলায় বলা হয় লিখিত সাহিত্য

নিম্নে সাজাকজাক ককরাবাই ও সুইজাকজাক ককরাবাই সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো । 

১. সাজাকজাক ককরাবাই: 

সাজাকজাক ককরাবাই বা কথ্য সাহিত্য হল মূলত সুদীর্ঘকাল ধরে লোকমুখে অলিখিতভাবে চর্চা হয়ে আসা সাহিত্যকে বোঝায়। বলা যায়, সুপ্রাচীনকাল থেকে ত্রিপুরারা লিখিত সাহিত্য চর্চার চেয়ে এই কথ্য সাহিত্যর উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। ঠিক সঙ্গীতগুলোও মুখে মুখে গেয়ে আসছে লোকগায়করা।  মুখে মুখে প্রচলিত এই লোকসাহিত্যগুলোর মধ্যে রয়েছে – বিভিন্ন লোককাহিনী, রূপকথা , কিংবদন্তি, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদি। এই কথ্য সাহিত্যগুলোই ত্রিপুরা জনজীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কেননা, সেখানে গল্পগুলোতে বা রূপকথাগুলোতে থাকে জুমিয়া জীবনের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি। লোককাহিনী ও রূপকথার মধ্যে রয়েছে- চেতুয়াং, নাগুই, মায়ুঙ কুফুলসা, জঙফা বুরা, তখাসা, চিবুক নারাজা ইত্যাদি কাহিনীগুলো। তেমনি লোকসঙ্গীতগুলোর মধ্যে রয়েছে – পুন্দা তানমানি, কুচুক হা সিকাম কামানি, লাঙ্গুই রাজান বুমানি, গাঁ তলিয়ো থামানি, হায়া দেশের’ থামানি, খুম কামানি ইত্যাদি গীতিকাব্য। এছাড়াও রয়েছে ত্রিপুরা ভাষায় প্রবাদ প্রবচন ও ধাঁধা । মূলত ত্রিপুরা ভাষায় প্রচলিত লোকসাহিত্যগুলোই এই সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত।

২. সুইজাকজাক ককরাবাই: 

সুইজাকজাক ককরাবাই বা লিখিত সাহিত্যের যাত্রা এই পর্যন্ত আমার জানামতে ১৯৩৬ সাল থেকে। শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরাই প্রথম এই যাত্রপথের সূচনা করেছিলেন তাঁর স্বরচিত ত্রিপুরা ভাষায় তেত্রিশটি গানের সংকলিত গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। আর ত্রিপুরা ভাষায় রচিত এই গ্রন্থের নাম রেখেছিলেন ‘ত্রিপুরা খা কাচকমা খুমবার বই’। যা বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক দলিল।

এই সুইজাকজাক ককরাবাই বা লিখিত ইতিহাসের সময়কালকে আমি মোট তিনটি ভাগে ভাগ করেছি। যেমন-

ক) বাংলাদেশ আচাইমানি সাকাঙনি জরা (১৯৩৬-১৯৭১), অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী যুগ

খ) বাংলাদেশ আচাইমানি উলনি জরা (১৯৭২-১৯৯৯) অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ

গ) কাতাল জরা (২০০০-বর্তমান)অর্থাৎ আধুনিক যুগ

এই যুগ বিভাজনের তিনটি যুগের মধ্যে শুধুমাত্র দু’টি যুগ অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় যুগটিই আমার আজকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কেননা বিংশ শতাব্দীতে এই দুই যুগের অবস্থান বেশ পাকাপোক্ত। এখানে যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয় সেটি হল- বিংশ শতকের শুরুর দিকের প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশে(তৎকালীন ব্রিটিশ সময়কালে) ত্রিপুরা ভাষায় কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার নজির মেলেনি। তাই ১৯৩৬ সালকেই বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার যাত্রাপথ ধরে আজকের এই আলোচনার প্রয়াস।   

ক) বাংলাদেশ আচাইমানি সাকাঙনি জরা (১৯৩৬-১৯৭১):

‘বাংলাদেশ আচাইমানি সাকাঙনি জরা’ অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বকাল থেকে বাংলাদেশের ত্রিপুরারা নিজেদের ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতেন এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতেন। যদিও এখনও আমরা শতবর্ষে উন্নীত হতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের পূর্বে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান সময়কালে চর্চাকৃত এদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যিকদের নিজ ভাষায় সাহিত্যকর্মগুলোকে নিয়ে এই সময়কালের সন্নিবেশ করার প্রয়াস পেয়েছি। তাই প্রথমেই যাঁর নামটি দিবালোকের মতো পরিস্কার ভেসে উঠে তিনি হলেন শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা ওরফে বলংরায় সাধু। ইতিপূর্বে আলোচিত তাঁর গ্রন্থটির নাম ‘ত্রিপুরা খা-কাচকমা খুমবার বই’। যা আমার দৃষ্টিকোন থেকে বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চাকারীদের গ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রথম।  ৩৩ টি ত্রিপুরা ভাষায় গানের সন্নিবেশ ঘটিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার বিএল প্রেস থেকে ১৯৩৬ সালে প্রকাশ করেছিলেন তিনি।  এই গ্রন্থটির আরো ব্যপক প্রচারের জন্য বাংলাদেশ ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ (বর্তমান নাম বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যান সংসদ) ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রামের হার্ডিঞ্জ প্রেস থেকে পূণর্মুদ্রণ করে। দ্বিতীয় মূদ্রণে গ্রন্থের স্বীকারোক্তিতে তৎকালীন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় বরেন ত্রিপুরা ১ নভেম্বর ১৯৭৮ তারিখে লিখেছিলেন- 

“পার্বত্য চট্টগ্রাম ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদের স্বার্থে শ্রদ্ধেয় সাধু শ্রীখুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার একমাত্র পুত্র শ্রী গোপাল কৃষ্ণ ত্রিপুরা মহাশয় বইখানি পুনর্মুদ্রনের অনুমতি প্রদান করায় তাঁহাদের উভয়ের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম।” 

শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার এই গ্রন্থটিতে মূলত ভক্তিমূলক গানগুলোই বেশি জায়গা করে নিয়েছে। তিনি শুরু করেছিলেন “খুলুঙ্কা ত্রিন্না বলি মা।” গানটির মাধ্যমে। এর পর দ্বিতীয় গানটি ছিল – “সাল কুরুই খাঁ সন্ধ্যা অংখা, ফাইদী আমারক। ডাকতী ফাইদী নক। ইয়াওকং নুইন, জোর খালাইখা। বাসাকন লকলৈ রোখা। আর তামা নাইজা নক।” অর্থাৎ সূর্য ডুবে গেল সন্ধ্যা হলো, এসো মায়েরা। তাড়াতাড়ি এসো তোমরা। দু’হাত জোড় করলাম। শরীর শোয়ে দিলাম। আর কি চাও তোমরা। এভাবে তিনি অনুরোধ জানিয়েছিলেন সাধারণ মায়েদের সন্ধ্যা আরতির জন্য।  তিনি তিন নম্বর গানে লিখেছেন- “গঙ্গা গয়া থাননী নাংইয়া, সাগ তঙ্গ তিত্তলায়।” অর্থাৎ গঙ্গা গয়া যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তীর্থতো স্বয়ং অঙ্গেই রয়েছে। কি দারুন দার্শণিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর গানগুলোতে, সত্যিই অতুলনীয়। তিনি নারীদের নিয়েও চমৎকার গান রচনা করেছিলেন। তিনি ১২ নং গানে লিখেছিলেন- “বিরক সামান্য ইয়া কিসি চাইয়া। বাড়ী কারাক ছে। গঙ্গা গয়া কাশী প্রয়াগ। বিরগ্নী ইয়া পাইয়াছে।” অর্থাৎ নারী সামান্য নয়, কমও নয়। খুবই শক্ত তারা। গঙ্গা গয়া কাশী প্রয়াগ সবই তার পদতলে। এভাবে আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনাগুলোকে সমাজের মানুষের জনজীবনের সাথে মিশ্রণ ঘটিয়ে খুবই অর্থবহ করে তুলেছেন তাঁর গানগুলো এই মহান পুরুষ। প্রতিটি গান যেন এক একটি জীবন দর্শনের এক গভীর অনুভূতি। 

বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার ইতিহাসটি ঠিক ত্রিপুরাদের জনজীবনের সাথে জড়িত তৈসা(ছড়া) এর মতো। কখনও ‘তৈখেরেঙ’ আবার কখনওবা ‘তোয়ারি’। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈখেরেঙ’ বলতে ছড়ার শুকনোপ্রায় অংশকে বোঝায়। ঠিক ছড়ার যে অংশের পানি শুকিয়ে যেতে বসেছে এমন কিন্তু এখনও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। আর কিছু অংশ আছে যেখানে কিছু পানি জমে এবং সবসময় পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, ছড়ার সেই অংশকে বলা হয় তোয়ারি। বলছি এই কারণে যে, বাংলাদেশের ত্রিপুরা লিখিত সাহিত্য স্বর্গীয় শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু ‘তাঁর ত্রিপুরা খা কাচাংমা খুমবার বই’ গ্রন্থের মাধ্যমে ১৯৩৬ সালে শুরু করলেও দীর্ঘ বছর ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সাহিত্যের ইতিহাসটা ঠিক তৈসার মতো। ত্রিপুরা রাজ্যের তড়িৎ মোহন দাসগুপ্ত তাঁর ‘বিদ্রোহী রিয়াং নেতা রতন মনি’ নামক গ্রন্থের ৭০ নং পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন- 

“বইখানির নাম ‘ত্রিপুরা রাচামুং খা কাচাংমা খুম্বার বাই’। প্রেসের নাম বিএল প্রেস(আগরতলা) সন ১৩৪৬ ত্রিং(১৯৩৬ইং) ১৪ই আশ্বিন। এই বইখানায় মোট ৩৩ টি গান আছে। এছাড়াও রতনমণির শিষ্যদের গুরুবন্দনার গান আছে। যা এই বহিতে ছাপানো হয়নি। কাঁঠালিয়ার শিষ্যদের নিকট প্রাপ্ত গুরু বন্দনার গানটি ‘রতনমণি ও রিয়াং বিদ্রোহ’তে ছাপানো হয়েছে। সেগুলি খুসীকৃষ্ণই নাকি রচনা করেছিলেন।” 

এমনকি তড়িৎ মোহন দাসগুপ্ত তাঁর ‘বিদ্রোহী রিয়াং নেতা রতন মনি’ নামক গ্রন্থে শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার ৩৩ টি গান বাংলা অনুবাদসহ চমৎকারভাবে ছাপিয়েছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা তাঁর ‘বাংলাদেশের ত্রিপুরা জাতির মানব সম্পদ’ গ্রন্থের ২৬ ও ২৮ নং পৃষ্ঠায় শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরাকে নিয়ে লিখেছিলেন-

“বলংরায় সন্ন্যাসী ত্রিশের দশকের কবি এবং সন্ন্যাসী। ঈশ্বরের ধ্যান ও চিন্তা চেতনার ফাঁকে তিনি অজস্র আধ্যাত্মিক ও ভক্তিমূলক বাউল সঙ্গীত সমূহ সীমার মাঝে অসীমকে অনুসন্ধানে অনুপ্রেরণা যোগায়। ত্রিপুরা জাতির সঙ্গীত ভূবনে তাঁর রচিত সঙ্গীতমালা বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।” 

এই গ্রন্থে শ্রদ্ধেয় লেখক শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার সংক্ষিপ্ত জীবনী। বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের সাহিত্যের দিকপাল বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি। ত্রিপুরা রাজ্যের স্বনামধন্য ত্রিপুরা লেখক শ্রী ধরিঞ্জয় ত্রিপুরা তাঁর ‘ত্রিপুরা জাতির পরিচিত’ নামক গ্রন্থের ১১৩ নং পৃষ্ঠায় এই সাহিত্যের দিকপালকে নিয়ে লিখেছিলেন- 

“৩০ দশকের ধর্মীয় আধ্যাত্মিক গান রচনা করে ছাপিয়ে প্রকাশ করার উদ্যোগটি সর্বপ্রথম খুশীকৃষ্ণ ত্রিপুরা নিয়েছিলেন।” 

বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় লিখিত সাহিত্য চর্চার সূচনা যে ১৯৩৬ সালে শ্রী খুসী কৃষ্ণ করেছিলেন এতে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই বলে আমি মনে করি। তবে বাংলাদেশের ত্রিপুরা জাতির সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ‘ত্রিপুরা খা-কাচাংমা খুমবার বই’ হলেও এর পরবর্তি দীর্ঘ বছর ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় যেন এক অকাল নেমে আসে। সাহিত্যের জমিনে নেই উর্বরতা। একদিকে রিয়াং সমাজে গুরু রতনমনির নেতৃত্বে সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং মহারাজার নির্দেশনায় রাজশক্তির হাতে প্রাণ যাওয়ার ভয়ে সাহিত্যিক খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার বন জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানো অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের দেশ বিভাগের ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, সব মিলিয়ে ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্যের পৃথিবী হয়ে উঠেছিল ধু ধু মরুভূমি। তেমনই এক অকাল সময়ে পুরোপুরি ত্রিপুরা ভাষায় না হলেও বাংলা ও ত্রিপুরা দু’টো ভাষায় নিজের গানসহ আরো কয়েকজনের গানের সংকলন করেন প্রখ্যাত লেখক শ্রদ্ধেয় শ্রী বরেন ত্রিপুরা তাঁর ‘অজানা পাহাড়ী সুর’ গ্রন্থে। প্রায় ত্রিশটি বছর পর এই যেন বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যের জগতে জ্বলে উঠলো আরেকটি প্রদীপ। আলোকিত করলো অন্ধকারাচ্ছন্ন ত্রিপুরা সাহিত্যকে। ২৫ টি গানের সংকলন এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে রাঙ্গামাটি থেকে । গানগুলো ত্রিপুরা ভাষার গান হলেও প্রতিটি গানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন দারুন শব্দচয়নে। গ্রন্থটির উপস্থাপনাও বাংলা ভাষাতে। এই গ্রন্থে ত্রিপুরা ভাষায় গানগুলো লেখার চর্চা করা হয়েছে বাংলা হরফে। অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরারা বরাবরই বাংলা হরফ ব্যবহার করতেন বলে মনে হয়েছে আমার। এই সংকলনটি নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী নন্দ লাল শর্মা তাঁর ‘সাহিত্য জগতে ত্রিপুরাদের ভূমিকা’ (‘পূব্-ই-রাবাইনি সাল্’ নামক সংকলনে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ) নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন-

“বিষয় বৈচিত্রে সংকলনটি স্বার্থক। আধ্যাত্মিক গান থেকে প্রেমের গান পর্যন্ত এ সংকলনে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। বরেন ত্রিপুরাকৃত বঙ্গানুবাদও গানগুলোর পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল।”

মূলত, পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সময়ে রাঙ্গামাটিতে ‘পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিল’ নামক একটি সংগঠনের রাঙ্গামাটি শাখা গঠন করার পর আদিবাসীদের কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে যখন ব্যপক চর্চা শুরু হয় তখন তাঁরাও সাহিত্যমনা চারজন মিলে ‘সবশনি সাহিত্য গোষ্ঠী’ গঠন করে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। এখানে ‘সবশনি’ শব্দটি তাঁদের চারজনের আদ্য-অক্ষর নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। যেমন- কবি সলিল রায়ের ‘স’, লেখক বরেন ত্রিপুরার ‘ব’, লেখক শফীক উদ্দীন আহমদের ‘শ’ এবং লেখক নির্মলেন্দু চৌধুরীর ‘নি’। এসময় তাঁরা বহু গান রচনা করেছিলেন। তারই একটি বহিঃপ্রকাশ ‘অজানা পাহাড়ী সুর’। তিনি এই গ্রন্থটিতে মোট ২৫ টি গান সংকলন করেছেন। তিনি শুধু নিজের লেখা গানগুলো সংকলন করেন নি। তিনি নিজের গানের পাশাপাশি সংকলন করেছিলেন শ্রী রতœমনি সাধু, শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা(বলংরায় সাধু) ও শ্রী মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরার মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের গানগুলোও। শ্রদ্ধেয় রতœমনি সাধুর একটি জনপ্রিয় গান তিনি সংকলন করেছিলেন। শিরোনামও দিয়েছিলেন ‘একটি মন শিক্ষা গান’ এবং শ্রী রতœমনির ত্রিপুরা ভাষায় লেখা এই গানটিকে তিনি চমৎকারভাবে বাংলায়ও অনুবাদ করেছি¬ে¬লন। তিনি এই গ্রন্থটিতে শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার দু’টি গানের জায়গা দিয়েছেন অতি যতেœ। একটি ‘ত্রিপুরা তীর্থ ডুম্বুর’ অন্যটি নারী(বিরক) নামের গান। দীর্ঘ দিনের গা ঢাকা দিয়ে থাকা গায়েন কবি শ্রী খুসী কৃষ্ণ যেন ফেরার সুযোগ পেলেন আবার ত্রিপুরা সাহিত্য জগতে। তাঁর এই গ্রন্থে সংকলিত ত্রিপুরা ভাষার গানগুলো বেশ শ্রুতিমধুর এবং অর্থবহ। গানগুলোর শিরোনাম ছিল – একটি ত্রিপুরা প্রেমের গান, ত্রিপুরা-তীর্থ ডুমবুর, নিষ্ফল জনম, পাহাড়ে বসন্ত(পারঅ সাচালাং), পাহাড়ী ঝরণা(তেরাং তোয় কালায়), জুমিয়া গাঁয়ে বিকাল(সারিনীকামি), নারী(বিরক্), পাহাড়ী-মেয়ে(বিরক্ সিকালা), পাহাড়ে শাওন, ফুরোমৌনের ডাক, সেখানেতে হারিয়েছিলাম চপল নয়না, জুমে ভাদর, বাঁশের বাঁশী, গরয়ার গান, বিরহিনী, তব শূণ্যতায় রচিতে তোমায়, বনের পাখী(বলংনি তকছা), এসেছে কে, সমর্পিত, আঁখি জলে ভাসি একা, আশায় আশায়, তবু কেন(তৌমৈ)? সে কোন বালিকা(সর’ অ বোরোইছা), একটি মনোশিক্ষা গান এবং বিষু দিনের স্মৃতি। সংকলক শ্রী বরেন ত্রিপুরা ১১ জুলাই, ১৯৬৬ ইং তারিখে তাঁর ‘দু’টি কথা’ লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন- 

“পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ পূর্বকোণে অবস্থিত পর্বত রাজি পরিবেষ্টিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জিলায় ত্রিপুরা বা টিপরা নামে যে জাতি তথা – উপজাতি বাস করে তাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য অনাদরে তথা-সংস্কার অভাবে আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। সেই ঝিমিয়ে পড়া ঘুমন্ত কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখার সংকল্প নিয়ে এই কাঁচা হাতে লেখনি ধারণ করেছি। এতে বহু ভুল-ভ্রান্তি যে থাকবে-বলা বাহুল্য।” 

এরপর তিনি শেষে লিখেছিলেন- 

“পরিশেষে আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বিদগ্ধ কোন কবির মনে রেখাপাত করতে পারবে কিনা জানি না তবুও আমি আমার জাতির অর্দ্ধ বিলোপ প্রাপ্ত কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সংকল্প নিয়েই লিখে যাব আমার এ ক্ষুদ্র গানের কলি- তথা- কবিতাগুচ্ছ।” 

এই যেন এক সাহিত্যমনের অনবদ্য প্রকাশ। নিজের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও প্রাণের টান যেন গভীর থেকে আরো গভীর এই প্রিয় লেখকের। এই গ্রন্থটিকে পরবর্তীতে ৩২ বছর পর ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশ করা হয় খাগড়াছড়ি থেকে। আর এই সংস্করণে ত্রিপুরা জাতির ৩৬টি দফা গরয়ার ৩৬ তাল অনুযায়ী ৩৬ টি গানের সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন লেখক। তিনি এই গ্রন্থে ‘রোওনি-বোওনি’ ও ‘পুন্দা তান্নায়’ নামক দু’টি গীতিকাব্যের কিছু অংশ ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। তাঁর এই সংস্করণের সবচেয়ে উেেল্লখযোগ্য দিক হলো, তিনি এই সংস্করণের শেষ গান অর্থাৎ ৩৬ নম্বর গানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে ত্রিপুরা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার ইতিহাসে ‘অজানা পাহাড়ী সুর’ যে জায়গা দখল করে রয়েছে তা সতিই অতুলনীয়। কেননা ১৯৩৬ সালের পরে ১৯৬৬ সালে অর্থাৎ দীর্ঘ ৩০ বছর পরে এই গ্রন্থটি ত্রিপুরা সাহিত্যে আলোর মশাল নিয়ে হাজির হয়েছিল। 

একসময় ত্রিপুরা অধ্যুষিত এলাকায় গ্রামে গঞ্জে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার ‘প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান’ গ্রন্থটি ।  ত্রিপুরা ভাষায় ২৪টি গান ও শেষে ‘বার অক্ষর ত্রিপুরা সংগীত’ নিয়ে লেখা এই গ্রন্থটি ঠিক কখন প্রকাশিত হয়েছিল তা বলা দুরহ ব্যাপার। কারণ এই গ্রন্থে প্রকাশকাল খুঁজে পাওয়া যায়নি। যদিও বিভিন্ন লেখকগণ এই গ্রন্থের প্রকাশকাল নির্ণয় করতে গিয়ে বিভিন্ন সাল নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে এখনও সঠিক সাল নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।  তবে এই গ্রন্থটি যে ১৯৭৭ সালের পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল তা অন্তত সুনিশ্চিত করে বলা যায়। কেননা  ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত  ‘বজন’ গ্রন্থের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেশ ত্রিপুরার লেখা সম্পাদকীয় অনুযায়ী ‘প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান’ গ্রন্থটি  ‘বজন’ গ্রন্থের পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেশ ত্রিপুরা তাঁর ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘বজন’ গ্রন্থের সম্পাদনার ‘দু’টি কথা’য় লিখেছেন-

“ইতিপূর্বে সাহিত্যিক-গবেষক শ্রীবরেন ত্রিপুরার একক রচনা বাংলা অনুবাদসহস ‘অজানা পাহাড়ী সুর’ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম থেকে শংকর চন্দ্র ত্রিপুরা কর্তৃক প্রকাশিত বলুংরায় সাধুর গানের একক সংকলন ‘প্রাণ কাচাংমা’ প্রকাশিত হয়েছে।”

এই গ্রন্থটি চট্টগ্রাম জেলার মিরশরাই থেকে শ্রদ্ধেয় শংকর চন্দ্র ত্রিপুরা কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিল। উক্ত প্রকাশক শ্রী শংকর চন্দ্র ত্রিপুরার সাথে আলাপে জানতে পারি গ্রন্থটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। বইয়ের সংকলিত গানগুলো বিভিন্ন শিরোনামে সাজানো। গ্রন্থে গানের সংখ্যা ২৪ টি এবং সর্বশেষ গানটি সাজানো হয়েছে স্বরবর্ণের আদ্যাক্ষর অ, আ, ই, ঈ, ঋ, ৯, এ, ঐ, ও, ঐ দিয়ে পর্যায়ক্রমে। তিনি এই গ্রন্থে গানগুলো শ্রেণিবিভাজন করেছেন-   গুরু বন্দনা, দেবী বন্দনা, শ্যামা আরতি, সন্ধ্য আরতি, আত্মতত্ত্ব, বাউল সুর, মনোশিক্ষা, কলিগান, ব্রহ্মপুত্র গঙ্গা স্নান, ভবের গান ইত্যাদি।  ‘প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান’ গ্রন্থটির শুরুতেই লেখক একটি আবেদন দিয়ে গ্রন্থের সূচনা করেছিলেন। আবেদনে লিখেছিলেন-

“ওঁ তৎসৎ মাসুরবী ওগতৈখা ফালক্ষীপদ জর্ম্মরখা মাফানি য়াপাইন কপাল বোওকখা গুমতি বোচকগ আচায়খা । দীক্ষাগুরু শিক্ষাগুরুনী য়াপাইন কপাল বোওকখা। যুগযুগ খুলুমকা যতহাময়া চায়ান মাফ্ বিখা। অকারান খুলুমকা সাকবাকসান’ য়াকরমখা। চেরাকন বড্ডারখা প্রণকাচাংমা রাচামমন ন চাচায়াফুং ছানানি উংখা। যতন মাফ্ বিখা অধম বলুংরায় আনন্দপুর আশ্রম খায়কা। সাধুভক্তজন য়াঠি রমৈ মাফবিখা সতর বছর উংখা আনন্দপুর তুংখা যতন শোনচাখা। ওঁ হরি যতন সাকা।”

অর্থাৎ বাংলায় অনুবাদ করলে এমন দাঁড়ায়, ওঁ তৎসৎ মা সুরবী গর্ভে ধারণ করেছে পিতা লক্ষীপদ জন্ম দিয়েছে আমায়। আমি তাঁদের চরণগুলো কপালে তুলে নিলাম। আমি গুমতির উজানে জন্মগ্রহণ করলাম। দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুররু চরণগুলো কপালে তুলে নিলাম। সবাইকে নমস্কার। যত অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলাম। বড়জনদের প্রণাম এবং সমবয়সীদের সাথে করমর্দন করলাম। কোমলমতি শিশুদের আশীর্বাদ করলাম এবং প্রাণকাচাংমার গানগুলো ভাল হোক আর মন্দ হোক শোনানোর প্রয়াস পেলাম। আনন্দপুর আশ্রম থেকে সবাইকে এই অধম বলংরায় প্রণাম জানালাম। দীর্ঘ সতের বছর ধরে আনন্দপুর আশ্রমে থেকে সবাইকে জাগানোর চেষ্টা করলাম। ওঁ হরি সবাইকে জানালাম। 

এই প্রাণ কাচাংমার প্রথম গানটির শিরোনাম গুরুবন্দনা। অত্যন্ত ভক্তিবাদী গান এটি। গুরুকে ভক্তি করার এক অনন্য বার্তা বহন করে এই গানটি। গানটিতে লিখেছেন-“গুরুনি য়াপায়ন রমৈ কচই তুংদি শালবাই হরবাই”। এরপর ২ নং গান অর্থাৎ দেবী বন্দনায় লিখেছেন- “আমানংশে সিয় সিদ্ধি বিদ্যা অবিদ্যান বিদ্যাপ্রকাশ খালায়দি....”, ৩ নং গান অর্থাৎ শ্যামা আরতিতে লিখেছেন- “যুগখুলুমকা মা ত্রিভঙ্গি ভঙ্গিমা শ্যামা....”, ৪ নং গান অর্থাৎ সন্ধ্যা আরতিতে লিখেছেন- “শালঠাকা সন্ধ্যাউংখা ফাইআমা ফায়....”, ৫ নং গান অর্থাৎ আত্মতত্বঃ তে লিখেছেন “খুলুমকা গোঁসাইরাতক খানাদি নাক কোকখোকচা সানানী উংখা...”, ৬ নং গান অর্থাৎ বাউল সুরে লিখেছেন- “নায়তৈ নায়তৈ অখলৈ ঠাংঅ রঐলামাকয়া...”,  ৭ নং গান অর্থাৎ মনোশিক্ষায় লিখেছেন- “ বাখানি বরকন কাছগয় রমদি...”, ৮ নং গানে লিখেছেন- “গঙ্গাগয়া কাঁশীপ্রয়াগ যতসাগ নাইদি....”, ৯ নং গান অর্থাৎ  মনশিক্ষায় লিখেছেন- “পালোকয়া পালোকয়া বাখা নুংলাংখা রুংনীবাগী...”। অসাধারণ আধ্যাত্মিক ভক্তিমূলক এই গানগুলোর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় আরেকটি গান হলো ১০ নং গানটি - “ত্রিপুরানী বফাংলে বাঠায়ঠায়তাম ছিচোক..”। ১১ নং গানে লিখেছেন- “সেবাসে পরম ধর্ম সেবাসে পরম বুদ্ধি সেবাভক্তি”, ১২ নং গান অর্থাৎ বাউলসুরে লিখেছেন- “আমা আপানোক খানাফায়দি দোক”, ১৩ নং গানে লিখেছেন- “ওঁকারন লাঠাখাগয় থুময়তুংসিদী..”, ১৪ নং গান অর্থাৎ কলির গানে লিখেছেন “নাগয় লাদি নোকযত কলিনী আচার..”, ১৫ নং গান অর্থাৎ ব্রহ্মপুত্র গান স্যানান এ লিখেছেন- “ধন্য ধন্য কলিউংখা ”, ১৬ নং গানে লিখেছেন- “স্বাধীনি খুমফাং খলাকাচারনি”, ১৭ নং গানে লিখেছেন- “বাসাগ তুংগ কারাকমা”, ১৮ নং গানে লিখেছেন- “বাখানিবরক সারব নাইদি”, ১৯ নং গান অর্থাৎ ভাবের গানে লিখেছেন- “সাকনী প্রাণ আখলয় ঠাঁলাংখা”, ২০ নং গানে লিখেছেন- “প্রেমবাতামা জাংগ্রীদয় কারায়”, ২১ নং গানে লিখেছেন “দুঃখীয়ানী দুর্গতিন কিচানাইদিমা”, ২২ নং গানে লিখেছেন- “ওঁমকারন গাড়ী খায়য় ঠানানি খায়দি”, ২৩ নং গানে লিখেছেন- “হায়রে পাষান্ডী বাখা তামায় গায়ঠালউংলাং”, ২৪ নং গানে লিখেছেন- “ঐখানাদি জগৎনি প্রাণ বাচাজাক কদমতলা”। এরপর শেষের গানটি হল ‘বার অক্ষর ত্রিপুরা সংগীত’ । স্বরবর্ণের আদ্যাক্ষর নিয়ে রচিত এই ভক্তিমূলক গানটিও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল ত্রিপুরা সমাজে। শ্রী খুসী কুষ্ণ ত্রিপুরার গানের সুর আলাদা। সকল গানগুলো নিজে সুর করে ভক্তবৃন্দকে শোনাতেন এবং গাওয়াতেন। ‘প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান’ প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা হরফে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পরেও ত্রিপুরা সাহিত্যে বাংলা হরফ এক অনন্য স্থান দখল করে ছিল । এই গ্রন্থটি শুধুমাত্র গানের সংকলন হিসেবে বিবেচনার যোগ্য নয়। এটি বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। 

আরেকটি বিষয় না বললেই নয় , সুইজাকজাক ককরাবাই বা লিখিত সাহিত্যে আমার বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য রচনার যুগ বিভাজনের প্রথম ভাগ অর্থাৎ বাংলাদেশ আচাইমানি সাকাঙনি জরা (১৯৩৬-১৯৭১) এর ভিতর এই তিনটি গ্রন্থ ব্যতীত আর কোন ত্রিপুরা ভাষায় রচিত গ্রন্থ আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তৎকালীন সময়ে গুটি কয়েক ত্রিপুরা লেখক বাংলা ভাষায় কিছু প্রবন্ধ, গল্প কবিতা বা অন্য কিছু লিখে থাকলেও ত্রিপুরা ভাষায় খুব বেশি পাওয়া যায় না। যেমন- ১৯৬২ সালে ‘রাঙ্গামাটি’ সংকলনে শ্রী উপেন্দ্র নাথ ত্রিপুরা লিখেছিলেন ‘পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণ কাহিনী’, শ্রী হরি কুমার ত্রিপুরা ১৯৬৬ সালে তুলা চাষ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কিন্তু আমার লেখা যেহেতু শুধুমাত্র ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চা নিয়ে সেহেতু বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কোন গ্রন্থ বা লেখা আমার আলোচ্য বিষয় নয়। তাই নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে মাত্র তিনটি গ্রন্থ আমার দৃষ্টিগোচর হয়। যদি স্বাধীনতা পূর্বকালীন সময়ে আরো কোন ত্রিপুরা ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ আমার দৃষ্টিগোচর হয় তাহলে অবশ্যই লেখাটিতে সংযোজনের প্রয়াস পাব। 

খ) বাংলাদেশ আচাইমানি উলনি জরা (১৯৭২-১৯৯৯):

বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের দ্বিতীয় ভাগের নাম রেখেছিলাম ‘বাংলাদেশ আচাইমানি উলনি জরা (১৯৭২-১৯৯৯)’ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ । এই সময়ের শুরুটা সাহিত্যে বেশ মন্দা কেটেছিল।  মুক্তিযুদ্ধের সময় অথবা তারও পরে যদিও বিভিন্ন লেখক বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ম্যাগাজিন সম্পাদনা, প্রবন্ধ লেখা, কবিতা লেখা ইত্যাদিতে জড়িত ছিলেন, তবুও দেশ স্বাধীন হওয়ার ৬ বছর পরও ত্রিপুরা ভাষায় কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার নজির দেখা যায় নি। যেমন- উদাহরণস্বরূপ বলা যায়  ১৯৭১ সালে শ্রদ্ধাভাজন শ্রী নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার সম্পাদনায় ঢাকা থেকে ‘রক্তে আনো লাল’ নামক একটি একুশের সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি আরো সম্পাদনা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘পদাতিক’ । জানা যায় অনিকেত অভাজন এবং কিশোর চৌধুরী ছদ্মনামেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে লিখতেন। এমনকি ‘দেশ’, দৈনিক পূর্বদেশ’, সংবাদ, সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকাগুলোতেও বেশ লিখতেন তিনি। পত্রিকা খোদ প্রাক্তন এমএলএ শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা ১৯৭৫ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লিখেছিলেন ‘ত্রিপুরা জাতিঃ উৎসের সন্ধানে’ নামক একটি প্রবন্ধ। [সূত্র: নন্দ লাল শর্মা, সাহিত্য জগতে ত্রিপুরাদের ভূমিকা(প্রবন্ধ), পূব্-ই-রাবাইনি সাল, প্রকাশকাল- ১৯৮১]। এভাবে লিখে গেছেন আরো অনেক ত্রিপুরা লেখক। শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা (যদিও গ্রন্থের লেখকের নাম বলরাম সাধু লেখা আছে) লিখেছেন ‘ধর্মের ভক্তিতত্ত্ব’ নামক বাংলা ভাষায় ভক্তিমূলক কিছু গান। যদিও গ্রন্থের সাল উল্লেখ নেই তবুও ধারণা করা হয় এই গ্রন্থটি স্বাধীনতার পর পরই তিনি তবলছড়ি থেকে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ত্রিপুরা ভাষায় লেখা খুঁজে পাওয়া দুরহ ব্যাপার হয়ে যায়।

‘প্রাণকাচাংমা ত্রিপুরা গান’ এর পর যে গ্রন্থটি বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে সেটি হল ‘বজন’। ‘বজন’ শব্দের বাংলা অর্থ কন্ঠস্বর। ১৯৭৭ সালে শ্রী সুরেশ ত্রিপুরার সম্পাদনায় রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে এ.কে.এম মকসুদ আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত এই গ্রন্থে বাংলা অনুবাদসহ সংকলিত হয় ত্রিপুরা ভাষায় বেশ কিছু কবিতা ও গান। গ্রন্থটিতে ত্রিপুরা ভাষার লেখাগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা হরফ। এই গ্রন্থে মোট সংকলিত হয়েছে ৫ টি কবিতা, ৬ টি গান ও ১ টি লিমেরিক। এই সংকলনের শুরু শ্রদ্ধাভাজন মিস প্রহেলিকা ত্রিপুরার কক্ মিল ‘চিনি হা’ কবিতার মধ্য দিয়ে। যদিও পরবর্তীতে সুর সংযোজন করে গানে রূপ দেওয়া হয়েছে। তিনি লিখেছেন- “ইসুক মাচাংমা চিনি হা..” প্রতিটি গান ও কবিতায় কখনও ফুটে উঠেছে পাহাড়ের জনজীবনের এক নিদারুন প্রতিচ্ছবি । আবার কখনওবা ফুটে উঠেছে প্রকৃতির অনন্য রূপ। ত্রিপুরা ভাষা বা বাংলা ভাষা দু’টোতেই খুঁজে পাই একরাশ মুগ্ধতা। যেমন – এই সংকলনের ২ নং প্রকাশিত গানটি ছিল তৎকালীন সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয় একটি গান। কথা ও সুর করেছেন শ্রদ্ধেয় লেখক ও শিল্পী শ্রী সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। গানের প্রথম কলিটি ছিল - “হুগ থানি ফাইদি নক ববৈরক হুগ থানি ফাইদি নক।” অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গানটিতে ফুটে উঠেছে একটি আহবানের সুর। একতাবদ্ধ হয়ে আগামীর সুন্দর পৃথিবী গড়ার একটি নতুন প্রত্যয়। গানটির বাংলা অনুবাদও রেখাপাত করে যায় হৃদয়ের গহীনে যথারীতি। এভাবে ৩ নং গানটি লিখেছেন শ্র্রদ্ধেয় শ্রী বরেন ত্রিপুরা। প্রথম লাইনটি ছিল- ‘হাপুং থায়ছানি ববইনি বজন্’ । এই গানের সুরকার শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেন ত্রিপুরা। পাহাড়ের বিভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে এই গানে। এই গানটি ভাষান্তর করেছেন স্বয়ং লেখক। আর ৪ নং ক্রমিকে ককমিল বা কবিতা লিখেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী হিরন্ময় রোয়াজা। ‘আইচোগ ছুমচানাই’ শিরোনামে লেখা এই কবিতায় কবি আহবান জানিয়েছেন ভোর বেলায় জেগে উঠে কৃষ্ণ নাম নিতে। অনেকটা আধ্যাত্মিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। ৫ নং ক্রমিকের গানটি রচনা করেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী বিশ্বকীর্তি ত্রিপুরা এবং সুরও দিয়েছেন তিনি। গানটির প্রথম লাইন ছিল- ‘ফাই ফাই ফাই ও লখি হৌগ থানি’। এই গানে প্রিয়াকে জুমে যাওয়ার আহবান ফুটে উঠেছে নতুন সুরে। ৬ নং ক্রমিকে সংকলিত হয়েছে শ্রদ্ধেয় শ্রী মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরার লেখা ও শ্রদ্ধেয় হরি কুমার ত্রিপুরার সুর করা ত্রিপুরা গান- “খেতারা বুলুংগ নুং তামা নায় ববই, সবনো নুং বাখা বাখা রনাই মালা সুবই। ” এটি একটি রোমান্টিক গান । অনেক উপমায় অলংকৃত গানের কথাগুলোও বেশ অনন্য। শ্রুতিমধুর গানে সুর বারে বারে বেঁজে উঠে কর্ণকুহরে। এভাবেই ৭ নং ক্রমিকে শ্রদ্ধেয় শ্রী ব্রজনাথ রোয়াজা লিখেছেন ‘বাত রকনাইমা’ কবিতাটি। বাংলায় অনুবাদ করে নামকরণ করা হলো ‘পাখী তাড়ানো মেয়ে’। তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরা ভাষায় খুব বেশি কবিতা প্রকাশিত হয়নি। এই ‘বজন’ গ্রন্থে লেখা কবিতাগুলো ত্রিপুরা ভাষায় নির্মিত কবিতার ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। ৮ নম্বরেও লেখা হয়েছে একটি কবিতা। ‘সাল্ কাখা’ নামকরণে কবিতাটি লিখেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা। বাংলায় অনুবাদ করে নামকরণ করেছেন ‘সূর্য উঠিছে’। ২১ লাইনের এই কবিতায় তিনি সবাইকে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন। রবির মতো আধাঁরকে দূর করার প্রত্যয় নেওয়ার কথা বলেছেন। জাগরণীমূলক এই কবিতায় কবি শব্দচয়ন করেছেন নিতান্ত সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায়। এরপর ৯ নং ক্রমিকে কবিতা লিখেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেন্দ্র নাথ রোয়াজা। কবিতার নাম ‘সর নিনি’। বাংলায় শিরোনাম দিয়েছেন ‘কে তোমার’। কবি তাঁর কবিতায় বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। আসলে কে কার জন্য এত ভালবাসা, এত মায়া। ১০ নং ক্রমিকে শ্রী মহেন্দ্র ত্রিপুরা লিখেছেন একটি গান । সুর করেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেশ ত্রিপুরা। ‘চায়া বিরি’ বা ‘বজ্জাত বউ’ নামে একটি লিমেরিক লিখেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী মঞ্জুলাল ত্রিপুরা এবং শেষে ১২ নম্বরে শ্রী সুরেশ ত্রিপুরার কথা ও সুরে লেখা হয়েছে- ‘সাকাং লামা হেমনাইরক’ জনপ্রিয় গানটি। এই গানগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য গানগুলো নিয়ে সম্পাদক তাঁর গ্রন্থের দু’টি কথায় লিখেছেন-

“প্রখ্যাত বেতার শিল্পী সুরেন ত্রিপুরার কন্ঠে বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানী লিমিটেড থেকে রেকর্ডকৃত সংকলনের ২ নং গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ৫ নং গানটি বেতার শিল্পী প্রহেলিকা ত্রিপুরার কন্ঠে বাংলা অনুবাদসহ চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছে। ৩ নং গানটি শ্রীবরেন ত্রিপুরার ‘অজানা পাহাড়ী সুর থেকে সংকলিত।”

সর্বোপরি, আমার দৃষ্টিতে ‘বজন’ স্বাধীনতা পরবর্তি ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার এক অনন্য উদাহরণ।  এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা ত্রিপুরা ভাষার শব্দগুলোকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি শুরু হয়েছে ত্রিপুরা ভাষায় কবিতা লেখার নতুন ধারা। আর প্রতিটি গানের কথায় ফুটে উঠেছে কখনও আহবানের সুর আর কখনওবা রোমান্টিকতার আনাগোনা। সব মিলিয়ে বজন নিঃসন্দেহে ত্রিপুরা ভাষার সাহিত্যকে করেছে বহুগুন সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য রচনায় শুরু হয়েছে নতুন ধারা। কেননা ঠিক এই সংকলনের পর পরই পরবর্তি প্রায় কয়েকটি বছর প্রকাশিত হয়েছে ত্রিপুরা ভাষায় নতুন নতুন গ্রন্থ, যা সমৃদ্ধ করেছে বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যকে। তাই আগামীর পর্বে সেই গ্রন্থগুলোর পরিচিত ও ইতিহাস নিয়ে হাজির হব আবারও। আপনাদের যে কোন ধরণের মন্তব্য আমার লেখনীকে আরো সমৃদ্ধ করবে। তাই সাথে থাকুন সবসময়।

বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় বাংলা ও রোমান হরফে সাহিত্য চর্চার ইতিহাসে আরেকটি নতুন সংযোজন ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’। এটি বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর একটি অন্যতম ধর্মীয় গ্রন্থ । অনেকের নিকট ত্রিপুরা গীতা নামেও পরিচিত।  গ্রন্থটি ত্রিপুরা ভাষায় অনুদিত। ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা’ গ্রন্থটি বাংলা ভাষার গীতাগ্রন্থ থেকে ত্রিপুরা ভাষায় অনুবাদ করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের দিঘীনালার কামাকুটছড়া(বর্তমানে মেম্বার পাড়া) নিবাসী শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার অন্যতম প্রিয় শিষ্য শ্রদ্ধেয় শ্রী চিত্তরঞ্জন ত্রিপুরা। গ্রন্থটি বাংলা হরফে খুব চমৎকারভাবে অনূদিত হয়েছে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন শ্রদ্ধেয় শ্রী সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা  এবং ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ৪ঠা ভাদ্র, ১৩৮৮ ত্রিপুরাব্দ, ১৩৮৫ বাংলায় (আগস্ট, ১৯৭৮খ্রি.) তারিখে প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থটি শ্রী গুরুপদ দে কর্তৃক চট্টগ্রামের হার্ডিঞ্জ প্রেস থেকে বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়েছিল। গ্রন্থটির মূল্য মাত্র ৫ টাকা। গ্রন্থের মলাটে লেখা আছে ‘ত্রিপুরা ভাষায় অনূদিত শ্রীমদ্ভাগবত গীতা  (কক-বোরকবাই সুইজাক)’, শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুর একটি ছবি, ছবির নিচে লেখা ‘গুরু গোঁসাই বুলুংরায় সাধুবাবা’ এবং মলাটের নিচের অংশে রয়েছে লেখকের নাম ‘শ্রী চিত্তরঞ্জন ত্রিপুরা’। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যে বাংলা ভাষার কোন গ্রন্থ থেকে ত্রিপুরা ভাষায় অনূদিত গ্রন্থের বিচারে এটিই প্রথম বলা যায়। যদিও অনেকটা শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার ধর্মীয় সংগীতের আদলে এই গীতা গ্রন্থের শ্লোকগুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে।  এই গ্রন্থের ‘কয়েকটি কথা’ লিখতে গিয়ে লেখক লিখেছেন- 

“পাঠকদের প্রতি আমার অনুরোধ মহাত্মা শ্রীমৎ স্বামি জোতিস্বরানন্দ গিরি গীতা গ্রন্থখানি পদাবলী গীতা কীর্ত্তন সুরে প্রকাশ করেন। শ্রীমৎ স্বামি নলিনানন্দ গীতারতœ ছন্দ বিশারদ ওঁ অখ- প্রাণের গীতা গ্রন্থখানি মানবজাতিকে হৃদয়ঙ্গম করাইবার জন্য রচনা করিয়াছেন। প্রকাশক ও রচয়িতা মহাশয়কে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিলাম। আমি গীতা গ্রন্থখানি পড়িয়া জানিতে পারিলাম নিজ নিজ আত্মার উদ্ধারের জন্য নিস্কাম কর্ম্মই শ্রেয় মনে করি। কুরুক্ষেত্র সমরাঙ্গণে শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনের সারথী হিসাবে যে কুরু সৈন্যদেরকে পরাজিত করিবার জন্য যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওক বলিয়া অর্জ্জুনকে বলিয়াছেন সেইটি হইল বর্হিজগত গীতা। এই গীতা গ্রন্থ হইল অন্তর্জ গতের কথা। তাই ত্রিপুরা বা বোরো (ক্) জাতির নর-নারীদের বুঝিবার সুবিধার্থে গীতা গ্রন্থখানি ত্রিপুরাদের ভাষায় অর্থাৎ কক্-বোরো (ক)- এ পদাবলী কীর্ত্তন-সুরে অনুবাদ করিলাম কিন্তু কবিতা রচনা ও ছন্দ সংযোজনা করার ব্যাপারে আমার আদৌ জ্ঞান নাই কারণ আমি কবি নই।”

কি চমৎকার উপস্থাপনা এই সাহিত্যিকের। তিনি গ্রন্থের প্রারম্ভে গুরু বন্দনা করেছেন অতি ভক্তিসহকারে। তাঁর দৃষ্টিতে গুরুই পৃথিবীর পৃথিবীর সমস্ত পথের দিশারী। তাঁর দৃষ্টিতে গুরুই জ্ঞানদাতা। স্বত্ত্ব-রজঃ-তমঃ গুনগুলো সবই গুরুর নিকট খুঁজে পান তিনি। সপ্তঋষি, পাহাড়-পর্বত, সাগর-নদী, কালী, শিব, গৌতম বুদ্ধ, ব্রহ্মা, কল্কী সবই তিনি খুঁজে পান এই গুরুর নিকট। এই পৃথিবীর সবকিছুই দায় দিয়েছেন তিনি গুরুর নিকট। তাই এই গ্রন্থের ১ম পৃষ্ঠায় তিনি প্রথমেই করেছেন গুরু বন্দনা, ২য় পৃষ্ঠায় করেছেন ‘আদি গুরু বন্দনা’। তিনি আদি গুরু বলতে বুঝিয়েছেন মাতা ও পিতাকে।  মাতার চরণে প্রণাম জানিয়েছেন তিনি। তিনি মাতা-পিতাকে শ্রদ্ধার সহিত ভক্তি করার কথা বলেছেন। মাকে তিনি তুলনা করেছেন বসুমতির সাথে এবং পিতাকে তিনি তুলনা করেছেন স্বর্গতুল্য। ৩য় পৃষ্ঠায় গানের মাধ্যমে আবার করেছেন গুরুবন্দনা। তিনি গুরুর চরনে প্রণাম জানিয়েছেন, অনুরোধ জানিয়েছেন আত্ম জ্ঞান প্রদানের, অজ্ঞানকে তাড়ানোর, মুক্তির পথ দেখানোর । এরপর ৪র্থ পৃষ্ঠায় ‘বাসাক তত্ত্ব গীতা’র বর্ণনা করেছেন নিদারুনভাবে। তিনি বলেছেন এই দেহটাই গীতা, ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্র এই দেহতেই। আমাদের দেহ পঞ্চতত্ত্ব নিয়েই গড়া। পঞ্চ পান্ডবও এখানেই বসা। এভাবে গানের সুরে ছন্দ মিলিয়ে লিখেছেন দেহতত্ত্বের কথা। কি আধ্যাত্মিক জ্ঞান তাছর। তবে গীতার মূল অধ্যায় শুরু করেছেন গীতার পঞ্চম পৃষ্ঠা থেকে। তিনি ৫ থেকে ৪৩ পৃষ্ঠা পর্যন্ত গীতার ১৮ টি যোগের বর্ণনা করেছেন এবং ৪৩ পৃষ্ঠায় গীতামাহাত্ম্যের বর্ণনাও করেছেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। যেমন- অধ্যায়ভিত্তিক শিরোনাম করেছেন এভাবে- প্রথম অধ্যায়- ‘বিষাদ যোগ’। তেমনি ত্রিপুরা ভাষায় লিখে দিয়েছেন ‘অর্জুন কাপমানি’, দ্বিতীয় অধ্যায়-‘সংখ্যা যোগ। ত্রিপুরা ভাষায় লিখেছেন লেখামানি। তৃতীয় অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘কর্মযোগ’, চতুর্থ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন-  ‘জ্ঞানযোগ’, পঞ্চম অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন-  ‘কর্ম্ম সন্যাস যোগ’, ষষ্ঠ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন-  ‘অভ্যাস যোগ’, সপ্তম অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন-  ‘জ্ঞান বিজ্ঞান যোগ’, অষ্টম অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন-  ‘অক্ষর ব্রহ্মযোগ’, নবম অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন-  ‘রাজবিদ্যা রাজগুহাযোগ’, দশম অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘বিভূতি যোগ’, একাদশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘বিশ্বরূপ যোগ’, দ্বাদশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘ভক্তি যোগ’, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘ক্ষেত্র ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগ যোগ’, চতুর্দ্দশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘গুণত্রয় বিভাগ যোগ’, পঞ্চদশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘পুরুষোত্তম যোগ’, ষোড়ষ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘দেব-অসুর বিভাগ যোগ’, সপ্তদশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ’, অষ্টাদশ অধ্যায়ে শিরোনাম দিয়েছেন- ‘মোক্ষ যোগ’। অধ্যায়গুলোর নামকরণে যেমন বাংলায় লিখেছেন তেমনি ত্রিপুরা ভাষায়ও অনুবাদ করে দিয়েছেন অত্যন্ত নিখুতভঅবে। অধ্যায়গুলোতে গানের সুরে সুরে ছন্দ মিলিয়ে উপস্থাপন করেছেন দেহতত্ত্বের কথা, শ্রী কৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন, গুরু শিষ্যের কথোপকথন। আবার কখনও উপস্থাপন করেছেন ‘ওঁ’ কারের কথা অথবা ব্রহ্মজ্ঞানের কথা, আশা-নিরাশার কথা ইত্যাদি। শেষে লিখেছেন গীতামাহাত্ম্য । তিনি গীতামাহাত্ম্যে গীতা মূল্য সম্পর্কে দারুনভাবে উপস্থাপন করেন। গানের সুরে।গানগুলো কখনও ‘ঝুমুর’ আবার কখনওবা ‘রাচামুং’ আবার মাঝখানে কিছু কথা ‘কওক’ । এভাবেই গীতার সমাপ্তি টেনেছেন এই গীতা প্রণেতা বা অনুবাদক। এই গ্রন্থের গুরুত্ব একদিকে ত্রিপুরাদের জনজীবনে যেমন ধর্মীয় গুরুত্ব বহন করে তেমনি বহন করে ত্রিপুরা সাহিত্যের গুরুত্ব। স্বাধীনতা পরবর্তী ত্রিপুরাদের বাংলা হরফে সাহিত্য চর্চায় এই গ্রন্থগুলোই অনন্য উদাহরণ। এই সাহিত্যসম্পদ সমৃদ্ধ ও গতিশীল করেছে ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার ইতিহাসকে।  আমি আগামী পর্বে আবারও হাজির হবো আরেকটি সাহিত্যের কথা নিয়ে। ধন্যবাদ সবাইকে।  

বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্য চর্চার আরেকটি অন্যতম নিদর্শন চৌত্রিশ পদাবলী (ককবরক)। এই গ্রন্থটির মলাটে উল্লেখ রয়েছে রচয়িতার নাম, স্থান ও প্রকাশ কাল। তিনি গ্রন্থটির রচয়িতা হিসেবে শ্রীমৎ বলংরাম (সাধু) নামটি ব্যবহার করেছেন। প্রকাশকাল উল্লেখ করা হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ ইং, ৫ ফাল্গুন ১৩৮৫ বাংলা। প্রকাশের স্থান উল্লেখ করা হয়েছে তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রামগড়ের তৈলাফাং মৌজা। এই গ্রন্থে শ্রীমৎ বলংরায সাধু বাংলা ব্যাঞ্জন বর্ণের চৌত্রিশটি অক্ষর দিয়ে গাণগুলোকে সন্নিবেশিত করেছেন। তবে তিনি বাংলা ব্যঞ্জন অক্ষরে গানগুলো লেখার পূর্বে ‘কক বড় ত্রিপুরা আরতি’ নামে দু’টি আরতি উপস্থাপন করেছেন। এরপর প্রথম গান ‘চৌত্রিশ অক্ষর পদাবলী নামে ‘ক’ হতে‘ঁ’ পর্যন্ত গানগুলো অতি সুন্দরভাবে সন্নি বেশিত করেন এবং শব্দ যেন থেকে শুরু করে গানের প্রতিটি লাইনের অর্থই অন্যন। তবে গ্রন্থে ‘ঝ’ অক্ষর দিয়ে গানের লাইনটি বোধহয় প্রিন্টিং এর সময় বাদ পড়ে গেছে। অর্থাৎ  মুদ্রনজণিত ত্রুটির কারণে ‘ঝ’ দিয়ে গানটা ছাপানো হয়নি। কেননা গ্রন্থটিতে ‘জ’ এর পর সরাসরি ঞ তে পৌঁছেছেন। ব্যঞ্জন বর্ণ অক্ষরগুলোর পরে তিনি শেষে মিলন শেষ গান “ত্রিপুরা রাচামুং” শিরোনামে প্রকাশ করেছেন। এই গ্রন্থটি শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুর রচিত ককবরক সাহিত্যের এক অপূর্ব সম্পদ।

শ্রীমৎ খুসী কৃষ্ণ বলংরায় সাধুর গ্রন্থসমূহের মধ্যে আরেকটি উজ্জল নিদর্শন ‘রামায়ন কীর্ত্তন’ নামক গ্রন্থটি। তিনি গ্রন্থটি ত্রিপুরা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থের মলাটে গ্রন্থটির নাম লেখা আছে রামায়ন কীর্ত্তন এবং রচয়িতার নাম লেখা আছে শ্রী শ্রী সাধু বাবা বলংরায় ত্রিপুরা। উক্ত গ্রন্থে প্রকাশকাল লেখা হয়েছে ১লা ফাল্গুন ১৩৯৫ ত্রিপুরাব্দ ১৩৯২ বাংলা। এই গ্রন্থে মূল রচনা ও প্রকাশনা শ্রীশ্রী সাধু বাবা বলংরায় ত্রিপুরা নামটি লিপিবদ্ধ থাকলেও লেখক হিসেবে আরো নাম রয়েছে তাঁর বিশ্বস্থ শিষ্যের। তিনি হলেন শ্রী চিত্তরঞ্জন ত্রিপুরা। শ্রী চিত্তরঞ্জন ত্রিপুরার আবাসস্থল খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার দীঘিনালা উপজেলার কামাকুটছড়ায়। আবার গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা। গ্রন্থটি ছাপা হয়েছে চট্টগ্রামের স্বদেশী ছাপাঘর থেকে। এই গ্রন্থের মূল্য লেখা আছে ১৪  (চৌদ্দ টাকা)। গ্রন্থটির পৃষ্টা সংখ্যা ৪৩। লেখকের কথা লিখতে গিয়ে শ্রীচিত্তরঞ্জন ত্রিপুরা বাংলায় লিখেছেন- 

“পাঠকের প্রতি আমার সপ্তকান্ড রামায়ন পদাবলী কীর্ত্তণগুরুদেব শ্রী শ্রী বলংরায় সাধুর ত্রিপুরা মাতৃভাষায় রচিত ত্রিপুরা নর-নারী বুপিবার সুবিধার্থে প্রকাশ করা হলো।

আমি জানি ত্রেতা যুগে স্বয়ং লক্ষী সীতা রাজা রামচন্দ্রের ঘরণী হিসেবে বহু কষ্ট ভোগ করেছেন। কাবরা, সীতা হলেন প্রকৃতি আরে‌্য রাম হলেন পুরুষ। এই দুইয়ের সংযোগে জীবের ভৌতিক দেহগতিত। এই প্রকৃতির বিনাকষ্টে আত্মার উদ্ধার সম্ভবপর নয়। দশ ইন্দ্রিয় রাজা রাবন হলেন ইন্দ্রিয় কর্তা, লক্ষণ বিবেক বুদ্ধি আরতনয় ইন্দ্রজিৎ মনস্বরূপ। বিবেক বুদ্ধি দ্বারাই মানুষ মনকে বশীভূত ও ইন্দ্রিয়সমূহকে দমন করতে পারে। যা প্রকৃত মুক্তির পথ। আর এ জন্য মানবকুলকে কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করা দরকার। পরিশেষে এই সপ্তকান্ড রামায়ন পদাবলী কীর্ত্তন গ্রন্থখানী আমার গোঁসাই শ্রী শ্রী বলংরায় সাধু বাবার নামে উৎসর্গ করলাম।” 

এই গ্রন্থের শুরুতেই রয়েছে “ওঁ মা রামায়ন কীর্ত্তন”। এর পর বন্দনা, বন্দানার পর রাচামুং। এরপর আবার দাইংসিনি বন্দনা। এর বিভিন্ন শিরোনাম দিয়ে গানগুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এই গ্রন্থে রাম, লক্ষণ, সীতার বনবাসের কাহিনিটি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এভাবে রামায়ন কীর্ত্তন ত্রিপুরা ভাষা-ভাষীদের জন্য রামায়নকে বোঝার একটি সহজ মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল তৎকালীন সময়ে।

বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার আকাশে আরেকটি তারা হয়ে জ¦লে উঠেছিল ‘পুন্দা তাননাই বা জিজুক পুন্দা’ নামক আরেকটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি মূলত সাজাকজাক ককরাবাই বা কথ্য সাহিত্যকে লিখিত রূপে জীবন দান করা। অর্থাৎ লালমতি আর হেমন্তের নিখুঁত প্রেমকাহিনী লোকমুখে প্রচলিত ছিল ত্রিপুরাদের জনজীবনে। ঠিক এই কাহিনীকে সংকলন করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয় ১৯৭৯ সালে।  গীতিকাব্যের পুরো গানটি গেয়েছিলেন শশী কুমার ত্রিপুরা , সংগ্রহ করেছেন মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সম্পাদনা করেছেন বরেন ত্রিপুরা। গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল মোট ২৬৮ টি। ৭ টি খন্ডে বিভক্ত গীতিকাব্যটিকে একত্রে প্রকাশ করেছিল ‘ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ’ ।  

এরপর ত্রিপুরা সাহিত্যের আকাশে ১৩৯০ ত্রিপুরাব্দে অর্থাৎ ১৯৮০ সালে যোগ হয় ‘খুম সাংদারি’ গ্রন্থটি। এটি একটি গানের সংকলনগ্রন্থ ছিল। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থের সম্পাদনা করেছিলেন শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা। বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ‘পূব-ই-রাবাইনি’ সাল নামক সংকলনগ্রন্থটি। যদিও গ্রন্থটিতে সবাই ত্রিপুরা ভাষা-ভাষীর লেকক নন এবং ত্রিপুরা হলেও সবাই ত্রিপুরা ভাষায় লেখেননি। তবুও এই গ্রন্থে অনেকেই ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার প্রয়াস পেয়েছেন। শ্রী বরেন ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত এই গ্রন্থে সম্পাদনার কাজে সহযোগিতা করেছিলেন শ্রী নবীন কুমার ত্রিপুরা, শ্রী ব্রজেন্দ্রনাথ ত্রিপুরা, শ্রী আতিরাম ধামাই এবং শ্রী বাতিরাম ত্রিপুরা। গ্রন্থটি ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে প্রকাশ করেছিল ‘ত্রিপুরা উপজাতি শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংসদ’। এই গ্রন্থে লিখেছিলেন শ্রী নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, শ্রী সলিল কৃষ্ণ দেববর্মা, শ্রীমতি কৃষ্ণা ত্রিপুরা, শ্রী দেনদোহা জলাই, শ্রী সুরজিৎ নারায়ন ত্রিপুরা, শ্রী বরেন ত্রিপুরা, শ্রীমতি শোভা ত্রিপুরা, শ্রী প্রশান্ত কুমার ত্রিপুরা, শ্রী অলিন্দ্র লাল ত্রিপুরা, শ্রীমতি করবী দেববর্মা, শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা, শ্রী দীনময় রোয়াজা, শ্রী সত্যরাং ত্রিপুরা, শ্রীমতি সুস্মিতা রোয়াজা, শ্রী কুবলেশ^ও ত্রিপুরা, শ্রীমতি কাবেরি ত্রিপুরা এবং শ্রী উপেন্দ্র নাথ ত্রিপুরা প্রমূখ সাহিত্যিকবৃন্দ। এরপর ‘কক সুরুংদি’ ত্রিপুরা ভাষা শিক্ষার একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি লিখেছিলেন শ্রী কুবিন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও শ্রী মহেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। ১৯৮১ সালে এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল সাকনি কক প্রচার সংসদ, গর্জনতলী, রাঙ্গামাটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম। পরবর্তী বছর  অর্থাৎ ১৯৮২ সালে (১৩৯২ ত্রিপুরাব্দে) শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা লেখেন ‘সাংদারি খুমবার’ নামক একটি ত্রিপুরা কবিতা সংকলন। গ্রন্থটি প্রকাশের ঠিক তিন বছর পর ১৩৯৫ ত্রিপুরাব্দে অর্থাৎ ১৩৯২ বঙ্গাব্দের ১ ফাল্গুন(১৯৮৫) প্রকাশিত  শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধুর ‘রামায়ন কীর্ত্তন’ ত্রিপুরাদের সাহিত্য জগৎ তথা ধর্মীয় সংগীত জগতে এক নতুন মাত্রা দান করে। এই গ্রন্থের মূল লেখক শ্রী শ্রী সাধু বাবা বলংরায় ত্রিপুরা লেখা থাকলেও লেখক হিসেবে শ্রী চিত্ত রঞ্জন ত্রিপুরার নামও উল্লেখ রয়েছে। গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা। গ্রন্থটি চট্টগ্রামের স্বদেশী ছাপাঘর থেকে মূদ্রিত হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে আরেকটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত ‘আইতারামা’ নামে। শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থের দিক নির্দেশনায় ছিলেন শ্রী সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এবং সহযোগিতায় ছিলেন শ্রী অরুনেন্দু ত্রিপুরা। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ ত্রিপুরা উপজাতি কল্যান সংসদ। ত্রিপুরা সাহিত্যের আকাশে আরেকটি উজ্জল নক্ষত্র ‘ত্রিপুরা ভাষা বা ককবরক ভাষার অভিধান ও ব্যাকরণ’ নামক একটি গ্রন্থ। বাংলা স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জন বর্ণের ধারাবাহিকতায় হাজারও শব্দার্থ নিয়ে অভিধান ও ব্যাকরণ গ্রন্থটি ত্রিপুরা ভাষা শিখার জন্য বেশ সহায়ক ছিল বলে মনে হয়। শ্রী সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরার লিখিত এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৯৬ বাংলার (১৯৮৯) আশি^ন মাসে। প্রকাশ করেছিল উপজাতীয় সংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙ্গামাটি। এরপর ১৯৯১ সালে অর্থাৎ ১৪০১ ত্রিপুরাব্দে প্রকাশিত হয় ‘ককবরক ও আদি শিক্ষা’।  শ্রীমতি শংখলতা ত্রিপুরার প্রকাশিত উক্ত গ্রন্থটি লিখেছিলেন শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা। একই বছর তিনি আরো লিখেছিলেন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য ‘কক বরক কক থাইরৗং’ নামক গ্রন্থ। খাগড়াছড়ির খাগড়াপুর থেকে একই প্রকাশক গ্রন্থগুলো প্রকাশ করেছিলেন।

এরপর ১৯৯১ সালে শ্রী প্রশান্ত ত্রিপুরা ও শ্রী শক্তিপদ ত্রিপুরার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘সান্তুয়া’ নামক একটি ম্যাগাজিন। যা পরবর্তীতে অনেকেই সম্পাদনা করে অনেক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। সেখানেও চর্চা হয় বাংলা ভাষার পাশাপাশি ত্রিপুরা ভাষায় গল্প, কবিতা, ছড়া ইত্যাদি। ১৯৯৩ সালে শ্রীমতি গীতা দেববর্মনের সম্পাদনায় ‘বানৌক’ নামক ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হয় ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম, বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে। আমার মনে হয় এটিই প্রথম ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের প্রকাশনা। ত্রিপুরা কল্যান ফাউন্ডেশন থেকে শ্রী মলয় ত্রিপুরা কিশোর এর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘লামপ্্রা’, এরপর আরো প্রকাশিত হয় হামকরাই, শ্রী বিনোতাময় ধামাই এর সম্পাদনায় ‘বৈসুক’, শ্রী মিলন জ্যোতি ত্রিপুরার সম্পাদনায় ‘হ-মাচাং’ ইত্যাদি ম্যাগাজিনগুলো, যেগুলোতে ত্রিপুরা ভাষায় লেখালেখির প্রয়াস পেয়েছেন তৎকালীন সাহিত্যমনা মানুষগুলো। এছাড়াও আমার অজান্তে ত্রিপুরা ভাষায় প্রকাশিত কিছু গ্রন্থ, ম্যাগাজিন বা সম্পাদক ও সাহিত্যিকের নাম রয়ে যেতে পারে। যদি এমন কিছু  রয়ে যায় তাহলে অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার বিনীত অনুরোধ রইল। 

১৯০০ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চা সত্যিই অতুলনীয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত উপেক্ষা করে তাঁরা নিজ ভাষায় সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তৎকালীন সময়ে। কোন প্রতিবন্ধকতাই তাঁদের সাহিত্য চর্চার গতিধারাকে থামাতে পারেনি। এগিয়ে নিয়েছেন অনেক দূর। হয়তোবা ভিন্ন ভাষার কিছু সমৃদ্ধ সাহিত্যের তুলনায় খুব বেশি সমৃদ্ধ নয়। তবুও, প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিবেশে সংগ্রাম করে যাওয়া জীবনের কঠিন সময়গুলোর মাঝেও সাহিত্যের আরাধনা করাটাইবা কম কিসের। তাই গেয়ে যেতে চাই জয়গান সেই সময়কালের অগ্রজদের, যাঁরা আমাদের সাহিত্য চর্চার পথকে করে তুলেছিলেন মসৃণ থেকে আরো মসৃণতর। যদিও আমাদের পাড়ি দিতে হবে আরো বহুদূর পথ।  

লেখক পরিচিতি: প্রভাষক, ইতিহাস বিভাগ, রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজ।


Post a Comment

0 Comments

এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও ব্যবহার বেআইনি