মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
বাংলাদেশের
ত্রিপুরা জাতির সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের অনন্য নিদর্শন ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ‘ত্রিপুরা খা-কাচাংমা খুমবার বই’ হলেও এর পরবর্তি দীর্ঘ বছর ত্রিপুরা
ভাষায় সাহিত্য চর্চায় যেন এক অকাল নেমে আসে। সাহিত্যের জমিনে নেই উর্বরতা। একদিকে
রিয়াং সমাজে গুরু রতনমনির নেতৃত্বে সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং মহারাজার নির্দেশনায়
রাজশক্তির হাতে প্রাণ যাওয়ার ভয়ে সাহিত্যিক খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার বন জঙ্গলে পালিয়ে
বেড়ানো অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ের দেশ বিভাগের ফলে রাজনৈতিক
পরিস্থিতির পরিবর্তন, সব মিলিয়ে
ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্যের পৃথিবী হয়ে উঠেছিল ধু ধু মরুভূমি। তেমনই এক অকাল সময়ে
পুরোপুরি ত্রিপুরা ভাষায় না হলেও বাংলা ও ত্রিপুরা দু’টো ভাষায় নিজের গানসহ আরো কয়েকজনের
গানের সংকলন করেন প্রখ্যাত লেখক শ্রদ্ধেয় শ্রী বরেন ত্রিপুরা তাঁর ‘অজানা পাহাড়ী সুর’ গ্রন্থে। প্রায় ত্রিশটি বছর পর এই
যেন বাংলাদেশের ত্রিপুরা সাহিত্যের জগতে জ্বলে উঠলো আরেকটি প্রদীপ। আলোকিত করলো
অন্ধকারাচ্ছন্ন ত্রিপুরা সাহিত্যকে। ২৫ টি গানের সংকলন এই গ্রন্থটি প্রকাশিত
হয়েছিল ১৯৬৬ সালে রাঙ্গামাটি থেকে । গানগুলো ত্রিপুরা ভাষার গান হলেও প্রতিটি
গানের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন দারুন শব্দচয়নে। গ্রন্থটির উপস্থাপনাও বাংলা ভাষাতে।
এই গ্রন্থে ত্রিপুরা ভাষায় গানগুলো লেখার চর্চা করা হয়েছে বাংলা হরফে। অর্থাৎ
তৎকালীন সময়ে ত্রিপুরারা বরাবরই বাংলা হরফ ব্যবহার করতেন বলে মনে হয়েছে আমার। এই
সংকলনটি নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী নন্দ লাল শর্মা তাঁর ‘সাহিত্য জগতে ত্রিপুরাদের ভূমিকা’ (‘পূব্-ই-রাবাইনি সাল্’ নামক সংকলনে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত
প্রবন্ধ) নামক প্রবন্ধে লিখেছিলেন-
“বিষয় বৈচিত্রে
সংকলনটি স্বার্থক। আধ্যাত্মিক গান থেকে প্রেমের গান পর্যন্ত এ সংকলনে অন্তর্ভূক্ত
হয়েছিল। বরেন ত্রিপুরাকৃত বঙ্গানুবাদও গানগুলোর পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল।”
মূলত, পাকিস্তান আমলে তৎকালীন সময়ে
রাঙ্গামাটিতে ‘পাকিস্তান আর্টস
কাউন্সিল’ নামক একটি
সংগঠনের রাঙ্গামাটি শাখা গঠন করার পর আদিবাসীদের কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে যখন ব্যপক
চর্চা শুরু হয় তখন তাঁরাও সাহিত্যমনা চারজন মিলে ‘সবশনি সাহিত্য গোষ্ঠী’ গঠন করে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন।
এখানে ‘সবশনি’ শব্দটি তাঁদের চারজনের আদ্য-অক্ষর
নিয়ে গঠন করা হয়েছিল। যেমন- কবি সলিল রায়ের ‘স’, লেখক বরেন ত্রিপুরার‘ব’, লেখক শফীক উদ্দীন আহমদের ‘শ’ এবং লেখক নির্মলেন্দু চৌধুরীর ‘নি’। এসময় তাঁরা বহু গান রচনা করেছিলেন। তারই একটি
বহিঃপ্রকাশ ‘অজানা পাহাড়ী সুর’। তিনি এই গ্রন্থটিতে মোট ২৫ টি গান সংকলন করেছেন। শ্রদ্ধেয়
লেখক শ্রী বরেন ত্রিপুারার ফাতুং দফার ভাষায় রচনা করেছিলেন একটি ত্রিপুরা প্রেমের
গান। গানটির কয়েক লাইন নিম্নরূপ-
“লখি ঐ লখি
রাংচাকমা সোনা কাইন্যা মা
সাকাং হিম্ পাইদে
ইয়ালুক্ মা
দিঁগল বাই কেশের্
ফাইদি থানা নো
বায়া বিরি নৈ বিনাতি দেশের্
গরা ডুশা গ
টেত্রেমা পুরুং
আনি লাখি ন সর খা
বুদ্ধি ফুরং
সাকাং হিম্ পাইদে
ইয়ালুক্ মা।।”
তিনি শুধু নিজের
লেখা গানগুলো সংকলন করেন নি। তিনি নিজের গানের পাশাপাশি সংকলন করেছিলেন শ্রী
রত্নমনি সাধু, শ্রী খুসী কৃষ্ণ
ত্রিপুরা(বলংরায় সাধু) ও শ্রী মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরার মতো বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের
গানগুলোও। শ্রদ্ধেয় রত্নমনি সাধুর একটি জনপ্রিয় গান তিনি সংকলন করেছিলেন। শিরোনামও
দিয়েছিলেন ‘একটি মন শিক্ষা
গান’ এবং শ্রী
রত্নমনির ত্রিপুরা ভাষায় লেখা এই গানটিকে তিনি চমৎকারভাবে বাংলায়ও অনুবাদ
করেছিলেন। গানটির কথাগুলোর নিম্নরূপ-
“নিনি লোক সাকাং
সাধেনি খুমফাং
আইচুক গ পেরফনি
নাইদি।।
আইচুক কারা দফার
উংফনি
খা-কাচাং মা
খুম্বার পের্ফনি
দিশা করই
বোমব্রাই ফাইগৈ
বাখাই নসে
তিলাংনা নাইদি।
বোর্চুক মান্দার
পের্গ চাগৈ
পান্থর, কোকিলা কুউ পুংফনি
বিছিংনি বাখা
থাংগ উরিগৈ
কোলোক্ কংকাং
তকছা পুংফনি
হাপার সিকালা
সাচালাং সাল’
দিশাকরই রতনমনি
বাখা জ্ঞান’ পালকনা নাইদি।”
তিনি বাংলায়
অনুবাদ করে লিখেছিলেন- (তব) মন বাগিচায় ভোরের বেলায় ফুটিয়া কত না ফুল করে নিতি মন
চুরি, প্রভাতীর আগমনে
ফুলে ফুলে আনমনে দিশেহারা অলিকুল নিতে চা্য় মধু হরি। রাঙিয়ে পুটে শিমুল মাদারে
পথিক কোয়েলের কুউ টানে, মন উড়ে যায়
নীলাম্বরে বন পাখীর আকুল গানে। সেই সব হারানো খনে ফাগুনের কুসুম বনে।(ওরে ও রতন)
হারাবে মন- মুকুতার দুল আকুল পাথারে ঘুরি।।
তিনি এই
গ্রন্থটিতে শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার দু’টি গানের জায়গা দিয়েছেন অতি যত্নে।
একটি ‘ত্রিপুরা তীর্থ
ডুম্বুর’ অন্যটি
নারী(বিরক) নামের গান। দীর্ঘ দিনের গা ঢাকা দিয়ে থাকা গায়েন কবি শ্রী খুসী কৃষ্ণ
যেন ফেরার সুযোগ পেলেন আবার ত্রিপুরা সাহিত্য জগতে। তিনি ডুম্বুর নিয়ে লিখেছেন-
“আমায়ৈ ডুম্বুর
মাতাই- নুং তামা নায়ৈ তং
হাপুং হাতাই
ছাবাই রখা বলং নি মায়ুং।।
ইয়াকশী ইয়াকগ্রা
হলং তয়্
অবিছিং গ বইয়ো
তোয়্
ফাতার্গ সক্ ফায়ৈ
নাইদি বসক তুয়ারী অং।।
সহস্র ধারা সাত
ঘাটি
কত মাতাই হামতি হামতি
পূর্ব গ তংমানি
জাগা পাইতকয়া-তা-অং।।
ছম চাগৈ হর চুং
নাই মা
চাগোই নাই খাই
কাপ্রাপ্ মা
বিনি খামা রিয়াং
পাড়া বছোক খাই তং।।
রাজ বাক্যনি মতে
তংগ
গুরু রত্ন সাগৈ
রগ
খা-সিলিয়া খুসী
কৃষ্ণ ইহানি অধম্।”
অর্থাৎ তাঁর এই
গ্রন্থে সংকলিত ত্রিপুরা ভাষার গানগুলো বেশ শ্রুতিমধুর এবং অর্থবহ। গানগুলোর
শিরোনাম ছিল – একটি ত্রিপুরা
প্রেমের গান, ত্রিপুরা-তীর্থ
ডুমবুর, নিষ্ফল জনম, পাহাড়ে বসন্ত(পারঅ সাচালাং), পাহাড়ী ঝরণা(তেরাং তোয় কালায়), জুমিয়া গাঁয়ে বিকাল(সারিনীকামি), নারী(বিরক্), পাহাড়ী-মেয়ে(বিরক্ সিকালা), পাহাড়ে শাওন, ফুরোমৌনের ডাক, সেখানেতে হারিয়েছিলাম চপল নয়না, জুমে ভাদর, বাঁশের বাঁশী, গরয়ার গান, বিরহিনী, তব শূণ্যতায় রচিতে তোমায়, বনের পাখী(বলংনি তকছা), এসেছে কে, সমর্পিত, আঁখি জলে ভাসি একা, আশায় আশায়, তবু কেন(তৌমৈ)? সে কোন বালিকা(সর’ অ বোরোইছা), একটি মনোশিক্ষা গান এবং বিষু দিনের
স্মৃতি। সংকলক শ্রী বরেন ত্রিপুরা ১১ জুলাই, ১৯৬৬ ইং তারিখে তাঁর ‘দু’টি কথা’ লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন- “পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণ পূর্বকোণে
অবস্থিত পর্বত রাজি পরিবেষ্টিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জিলায় ত্রিপুরা বা টিপরা নামে
যে জাতি তথঅ – উপজাতি বাস করে
তাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্য অনাদরে তথা-সংস্কার অভাবে আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। সেই
ঝিমিয়ে পড়া ঘুমন্ত কৃষ্টি আর সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখার সংকল্প নিয়ে এই কাঁচা হাতে
লেখনি ধারণ করেছি। এতে বহু ভুল-ভ্রান্তি যে থাকবে-বলা বাহুল্য।” এরপর তিনি শেষে লিখেছিলেন- “পরিশেষে আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা
বিদগ্ধ কোন কবির মনে রেখাপাত করতে পারবে কিনা জানি না তবুও আমি আমার জাতির অর্দ্ধ
বিলোপ প্রাপ্ত কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সংকল্প নিয়েই লিখে যাব আমার
এ ক্ষুদ্র গানের কলি- তথা- কবিতাগুচ্ছ।” এই যেন এক সাহিত্যমনের অনবদ্য
প্রকাশ। নিজের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও প্রাণের টান যেন গভীর
থেকে আরো গভীর এই প্রিয় লেখকের। এই গ্রন্থটিকে পরবর্তীতে ৩২ বছর পর ১৯৯৮ সালে
দ্বিতীয় সংস্করণে প্রকাশ করা হয় খাগড়াছড়ি থেকে। আর এই সংস্করণে ত্রিপুরা জাতির
৩৬টি দফা গরয়ার ৩৬ তাল অনুযায়ী ৩৬ টি গানের সন্নিবেশ ঘটিয়েছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ
করেছেন লেখক। তিনি এই গ্রন্থে ‘রোওনি-বোওনি’ ও ‘পুন্দা তান্নায়’ নামক দু’টি গীতিকাব্যের কিছু অংশ ব্যাখ্যাসহ
তুলে ধরেন অত্যন্ত সুন্দরভাবে। তাঁর এই সংস্করণের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তিনি এই সংস্করণের শেষ গান অর্থাৎ
৩৬ নম্বর গানে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে ত্রিপুরা ভাষায় অনুবাদ
করেছিলেন।
এই গ্রন্থ
সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক শ্রদ্ধেয় শ্রী মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা ‘গিরিপ্রভা’ নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁর লেখা
‘অজানা পাহাড়ী সুরে একজন রোমান্টিক
বরেন ত্রিপুরাকে আবিষ্কার’ নামক প্রবন্ধে(৭৮
নং পৃষ্ঠা) লিখেছেন-
“গানের সিলেকশন, সংগীতক্রম সাজানো, গানগুলোর ভাবানুবাদে প্রয়োগ করা
ভাষা শৈলি সব মিলিয়ে বরেন্য এই লেখকের ভেতরে বাস করা একজন রোমান্টিক কবিকে
আবিষ্কার করি আমরা। তাছর নিজের লেখা প্রতিটি গানেও তিনি ভাষা ও ছন্দ নিয়ে খেলেছেন
দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো। প্রয়াগ করেছেন নানা লোক গীতিকাব্যের ছন্দ আর অলংকার, যার সাথে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন
পরিমাণমতো আধুনিক ভাবনা।”
বাংলাদেশের
ত্রিপুরা ভাষায় বাংলা ও রোমান হরফে সাহিত্য চর্চার ইতিহাসে ‘অজানা পাহাড়ী সুর’ যে জায়গা দখল করে রয়েছে তা সতিই
অতুলনীয়। কেননা ১৯৩৬ সালের পরে ১৯৬৬ সালে অর্থাৎ দীর্ঘ ৩০ বছর পরে এই গ্রন্থটি
ত্রিপুরা সাহিত্যে আলোর মশাল নিয়ে হাজির হয়েছিল। আরেকটি বিষয় না বললেই নয় , সুইজাকজাক ককরাবাই বা লিখিত
সাহিত্যে আমার বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য রচনার যুগ বিভাজনের প্রথম ভাগ
অর্থাৎ বাংলাদেশ আচাইমানি সাকাঙনি জরা (১৯৩৬-১৯৭১) এর ভিতর আর কোন ত্রিপুরা ভাষায়
রচিত গ্রন্থ আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। তৎকালীন সময়ে গুটি কয়েক ত্রিপুরা লেখক বাংলা
ভাষায় কিছু প্রবন্ধ, গল্প কবিতা বা
অন্য কিছু লিখে থাকলেও ত্রিপুরা ভাষায় খুব বেশি পাওয়া যায় না। ত্রিপুরা ভাষায় কোন
গ্রন্থই প্রকাশিত হইনি। যেমন- ১৯৬২ সালে ‘রাঙ্গামাটি’ সংকলনে শ্রী উপেন্দ্র নাথ ত্রিপুরা
লিখেছিলেন ‘পশ্চিম পাকিস্তান
ভ্রমণ কাহিনী’, শ্রী হরি কুমার
ত্রিপুরা ১৯৬৬ সালে তুলা চাষ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কিন্তু আমার লেখা
যেহেতু শুধুমাত্র ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চা নিয়ে সেহেতু বাংলা ভাষায় প্রকাশিত
কোন গ্রন্থ বা লেখা আমার আলোচ্য বিষয় নয়। তাই নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
পূর্ববর্তী সময়ে মাত্র ২ টি গ্রন্থ আমার দৃষ্টিগোচর হয়। পড়ার সুযোগ পাই। তাই
আমাদের পরবর্তী আলোচনা হবে স্বাধীনতা পরবর্তী ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য চর্চার
ইতিহাস নিয়ে। আপনাদের যে কোন মতামত আমার লেখাকে সমৃদ্ধ করতে সহযোগিতা করবে।
-ক্রমশ চলবে-
0 Comments