বাংলাদেশের
ত্রিপুরা ভাষায় বাংলা ও রোমান হরফে সাহিত্য চর্চার ইতিহাসটি ঠিক ত্রিপুরাদের
জনজীবনের সাথে জড়িত তৈসা(ছড়া) এর মতো। কখনও ‘তৈখেরেঙ’ আবার কখনওবা ‘তোয়ারি’। ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈখেরেঙ’ বলতে ছড়ার শুকনোপ্রায় অংশকে বোঝায়।
ঠিক ছড়ার যে অংশের পানি শুকিয়ে যেতে বসেছে এমন কিন্তু এখনও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি।
আর কিছু অংশ আছে যেখানে কিছু পানি জমে এবং সবসময় পানিতে পরিপূর্ণ থাকে, ছড়ার সেই অংশকে বলা হয় তোয়ারি।
বলছি এই কারণে যে, বাংলাদেশের ত্রিপুরা লিখিত সাহিত্য
স্বর্গীয় শ্রীখুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা বলংরায় সাধু ‘তাঁর ত্রিপুরা খা কাচাংমা খুমবার বই’ গ্রন্থের মাধ্যমে ১৯৩৬ সালে শুরু
করলেও দীর্ঘ বছর ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্য গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সাহিত্যের
ইতিহাসটা ঠিক তৈসার মতো। তবে সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে তাঁর এই গ্রন্থটি নিয়ে কিছু
লেখকের মন্তব্য আপনাদের জানাতে চাই। ত্রিপুরা রাজ্যের তড়িৎ মোহন দাসগুপ্ত তাঁর ‘বিদ্রোহী রিয়াং নেতা রতন মনি’ নামক গ্রন্থের ৭০ নং পৃষ্ঠায়
লিখেছিলেন-
“বইখানির নাম ‘ত্রিপুরা রাচামুং খা কাচাংমা
খুম্বার বাই’। প্রেসের নাম বিএল প্রেস(আগরতলা) সন ১৩৪৬ ত্রিং(১৯৩৬ইং) ১৪ই
আশ্বিন। এই বইখানায় মোট ৩৩ টি গান আছে। এছাড়াও রতনমণির শিষ্যদের গুরুবন্দনার গান
আছে। যা এই বহিতে ছাপানো হয়নি। কাঁঠালিয়ার শিষ্যদের নিকট প্রাপ্ত গুরু বন্দনার
গানটি ‘রতনমণি ও রিয়াং
বিদ্রোহ’তে ছাপানো হয়েছে।
সেগুলি খুসীকৃষ্ণই নাকি রচনা করেছিলেন।”
এমনকি তড়িৎ মোহন
দাসগুপ্ত তাঁর ‘বিদ্রোহী রিয়াং
নেতা রতন মনি’ নামক গ্রন্থে
শ্রীখুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার ৩৩ টি গান বাংলা অনুবাদসহ চমৎকারভাবে ছাপিয়েছিলেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা তাঁর ‘বাংলাদেশের ত্রিপুরা জাতির মানব
সম্পদ’ গ্রন্থের ২৬ ও ২৮
নং পৃষ্ঠায় শ্রী খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরাকে নিয়ে লিখেছিলেন-
“বলংরায় সন্ন্যাসী
ত্রিশের দশকের কবি এবং সন্ন্যাসী। ঈশ্বরের ধ্যান ও চিন্তা চেতনার ফাঁকে তিনি অজস্র
আধ্যাত্মিক ও ভক্তিমূলক বাউল সঙ্গীত সমূহ সীমার মাঝে অসীমকে অনুসন্ধানে অনুপ্রেরণা
যোগায়। ত্রিপুরা জাতির সঙ্গীত ভূবনে তাঁর রচিত সঙ্গীতমালা বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করতে
সক্ষম হয়।”
এই গ্রন্থে
শ্রদ্ধেয় লেখক শ্রী প্রভাংশু ত্রিপুরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন
শ্রীখুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরার সংক্ষিপ্ত জীবনী। বাংলাদেশের ত্রিপুরাদের সাহিত্যের
দিকপাল বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি। ত্রিপুরা রাজ্যের স্বনামধন্য ত্রিপুরা লেখক
শ্রী ধরিঞ্জয় ত্রিপুরা তাঁর ‘ত্রিপুরা জাতির পরিচিত’ নামক গ্রন্থের ১১৩ নং পৃষ্ঠায় এই
সাহিত্যের দিকপালকে নিয়ে লিখেছিলেন-
“৩০ দশকের ধর্মীয়
আধ্যাত্মিক গান রচনা করে ছাপিয়ে প্রকাশ করার উদ্যোগটি সর্বপ্রথম খুশীকৃষ্ণ
ত্রিপুরা নিয়েছিলেন।”
এছাড়াও
বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক শ্রদ্ধেয় শ্রী মথুবা বিকাশ ত্রিপুরা তাঁর ‘ত্রিপুরা সমাজ সংস্কৃতি ও জীবিকা’ নামক গ্রন্থের ৬২ নং পৃষ্ঠায়
লিখেছিলেন-
“বাংলাদেশে ককবরকে
লেখালেখির প্রকাশিত নিদর্শন হলো উনিশশত চল্লিশ দশকের প্রথম দিকে সাধক খুসীকৃষ্ণ
ত্রিপুরা কর্তৃক রচিত ককবরক আধ্যাত্মিক সংগীত। তাঁর লেখা ৩৩ টি আধ্যাত্মিক ককবরক
সঙগীত নিয়ে ১৯৪২ সালে ত্রিপুরা খা-কাচাংমা খুম্বার বই’ নামের এই গানের বইটি প্রকাশিত হয়।
এই গানের বইটিকে বাংলাদেশের ককবরকের লিখিতরূপের সূচনালগ্ন হিসেবে গণ্য করা যায়।”
বাংলাদেশের
ত্রিপুরা ভাষায় লিখিত সাহিত্য চর্চার সূচনা যে ১৯৩৬ সালে শ্রী খুসী কৃষ্ণ করেছিলেন
এতে কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই বলে আমি মনে করি। কিন্ত ‘ত্রিপুরা খা কাচাংমা খুমবার বই’ গ্রন্থের পর কোন গ্রন্থটিকে
বাংলাদেশের ত্রিপুরা ভাষায় সাহিত্যগ্রন্থ বলা যায় এবং সেই গ্রন্থগুলো নিয়ে আগামী
পর্বে আবারও ফিরতে চাই। ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাদের যদি এই লেখাগুলো নিয়ে কোন কিছু
মন্তব্য করার থাকে বা পরামর্শ থাকে তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট বক্সে লিখে জানাতে
পারেন।
-ক্রমশ চলবে-
0 Comments