মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
মংছেন চীং (মংছিন্), নামটি বাংলাদেশের লেখালেখি ও সাহিত্য জগতের এক অনন্য নাম। তরুন লেখকদের একটি অনুপ্রেরণার নামও বটে। তিনি শুধুই গবেষক ছিলেন না, ছিলেন সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মীও। আমার জানামতে, তিনিই পার্বত্য অঞ্চলের একমাত্র একুশে পদক (২০১৬) প্রাপ্ত গবেষক। আজ এই মহান গবেষকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গবেষকের প্রতি জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা।
এই মহান মানুষের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ, আমার জীবনের কিছু সময়কে করে তুলেছিল আলোময়। পরিচয়টা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা শ্রী মংছেনলাইন (বর্তমানে উক্ত প্রতিষ্ঠানেই উপসচিব পদে কর্মরত আছেন) দাদার হাত ধরে। সময়টা ছিল গিরিপ্রভা ম্যাগাজিনে লেখা সংগ্রহের । ফোনে আলাপের মধ্য দিয়ে পরিচয়টা শুরু। শুরু থেকেই সম্বোধন করতাম আঙ্কেল বলে। এর পর তো বিভিন্ন সময় দেখা। কখনও জমে উঠতো পাহাড়ের গল্প অথবা লেখালেখির নিঁখুত আলাপন।
এই মহান ব্যক্তিত্ব প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী শ্রদ্ধেয় মংছেনচীং (মংছিন্) ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে
১৬ জুলাই রোজ শুক্রবার গ্রহরাজ সিংহ রাশি জাতক কক্সবাজার পৌরসভার চাউলবাজার সড়কস্থ
(রাখাইন পাড়া) একটি সম্ভ্রান্ত রাখাইন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম স্বর্গীয়
উ-অংচাথোয়েন ও মাতার নাম স্বর্গীয় ড-মাক্যচীং। পাঁচ ভাই ও এক বোনের তিনি কনিষ্ঠ। তাঁর লেখালেখির চর্চা শৈশবকাল থেকে। শৈশব থেকে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি শীর্ষস্থানীয় পত্র-পত্রিকায় রাখাইন জাতির ইতিহাস,
ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ে লেখালেখি করেছেন বহুবার। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কথিকা লেখক ও পাঠক। জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার সাথে । তিনি ছিলেন ঢাকাস্থ বাংলাদেশ ফোকলোর (গ্রামীণ লোক সাহিত্য) সোসাইটি, বিশ্ব বাংলা সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন, খাগড়াছড়ি জেলা শাখা কেন্দ্রীয় কার্য
নির্বাহী পরিষদ- এর সদস্য ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ও টাঙ্গাইল ছায়ানীড় -এর
আজীবন সদস্য।
অনন্য প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি কক্সবাজার কলেজে অধ্যয়নরত সময় ইউওটিসি (ট.ঙ.ঞ.ঈ) ডিটাসমেন্টের একজন ক্যাডেট ছিলেন।
তিনি
উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর বাইবেল বিষয়ে ডিপ্লোমা পাস করেন। তিনি অনেক পদক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন।
ছাত্র জীবনে তিনি সাহিত্য, সাংস্কৃতি ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অসংখ্য
পুরস্কারপ্রাপ্ত। ‘সম্মাননা সনদ’ ২০১৩খ্রি. বাংলা, রাখাইন সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় বিশেষ
অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ, আলোক নব গ্রহ ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা
কমিটি, খাগড়াছড়ি
সদর, খাগড়াছড়ি
হতে শুভ - বুদ্ধ পূর্ণিমা’ ২০১৩ খ্রি.। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা; শুদ্ধ বানানে শুদ্ধ উচ্চারণে ‘উপজেলা কর্মশালার’২০১৩ খ্রি. ছায়ানীড় ভাষা গবেষণা বিভাগ,
টাঙ্গাইল ‘সম্মাননা সনদ’২০১৩ খ্রি. (তারিখ ২০ জুন ২০১৩খ্রি.)।
সাহিত্য বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সুন্দরবন আঞ্চলিক সাহিত্য সম্মেলন
২০১৪খ্রি. ‘সম্মাননা সনদ’ কবিতীর্থ, কালীগঞ্জ, সাতক্ষীরা, ব্যবস্থাপনায়: বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি,
কালিগঞ্জ শাখা,
সাতক্ষীরা
(তারিখ ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ খ্রি.)। ছায়ানীড়ের ২৬ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ২০১৪ খ্রি.
‘ছায়ানীড়
স্মারক সম্মাননা’ জাতীয় জাদুঘর, কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, শাহবাগ, ঢাকা (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ খ্রি.)। ২২
মে ২০১৪ ঢাকা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ভিআইপি সেমিনার হল শাহবাগ-এর পান্ডুলিপি
পরিষদ ও পিস ওয়ার্ল্ড সংস্থার পক্ষ থেকে আঞ্চলিক ভাষা ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য
‘কবি
নজরুল স্মারক সম্মাননা-২০১৪’ প্রদান করা হয়। মুর্শিদাবাদ রাহিলা সংস্কৃতি
সংঘ-এর ৩০ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে, ২১ ফেব্রুয়ারির বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহিদদের
স্মরণে এবং বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষিতে সাহিত্য সংস্কৃতি উৎসব-এর ‘রাহিলা সাহিত্য পুরস্কার-২০১৫’ প্রদান করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
একাডেমি সভাঘর (নন্দন চত্ত্বর, কোলকাতা)। খুলনা প্রবন্ধ ও গবেষণা সাহিত্য ‘ফুল কলি পুরস্কার-২০১৬’ ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
কর্তৃক গবেষণা ক্ষেত্রে গৌরবময় ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৬ সালের
একুশে পদক’ এ ভূষিত করা হন- ২০/০২/২০১৬ খ্রিস্টাব্দে। একুশে পদক পাওয়ার পরবর্তী
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পক্ষ হইতে গুণীজন সংবর্ধনা
ও সম্মাননা প্রদান করা হয়। ১৯৮৭ হতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের
পপুলেশন কনসার্ন পরিচালিত রাখাইন সমম্বিত পরিবার কল্যাণ প্রকল্পের কক্সবাজার ও
বান্দরবান পার্বত্য জেলা ‘প্রকল্প পরিদর্শক’ পদে চাকুরিরত ছিলেন।
‘রাখাইন’ সাময়িকীর সম্পাদক, পার্বত্য অঞ্চল (রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি)’র সর্বপ্রথম ও চট্টগ্রাম বিভাগের সংবাদপত্র সাপ্তাহিক বনভূমি ও দৈনিক গিরি দর্পণ পত্রিকায় বিশেষ প্রতিনিধি (সমগ্র বাংলাদেশ) হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী মি. মংছেনচীং (মংছিন্)- এর লেখা প্রকাশিত বাংলাদেশ রাখাইন জাতির সর্বপ্রথম ও একমাত্র গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘রাখাইন ইতিবৃত্ত’ সুধী পাঠক সমাজে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৭টি, বাংলাদেশের রাখাইন পরিচিতি, রাখাইন ইতিবৃত্ত, সৈকত নন্দিনী (কবিতা), রাখাইন-বাংলা কথোপকথন (ভাষা শিখুন, প্রথম পাঠ), অগ্গমেধা বৌদ্ধ মন্দির এবং উ কেঁসাল্লা মহাথেরো, ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ, শুভ-অশুভ দিন পঞ্জিকা (রাখাইন ভাষায়), রাখাইনালোক (ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়), রাখাইন জাতির রত্ন, রাখাইনাদর্শ, রাখাইন-বাংলা কথোপকথন ভাষা শিখুন, বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন, রাখাইন-ত্রিপুরা জাতিসত্তা, আলোক নবগ্রহ ও ভদন্ত চন্দ্রমণি মহাথেরো, খাগড়াছড়ি, আলোকিত রাখাইন (রাখাইন আলাং/ রাখাইন ভাষা) এবং সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৪টি (তথ্যসূত্র: গিরিপ্রভা)।
তাঁর সহধর্মিণী শ্রদ্ধেয় শোভা রাণী ত্রিপুরা, যাঁকে আমি আন্টি বলেই সম্বোধন করি। পেশায় ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা(বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) ও সুপ্রতিষ্ঠিত লেখিকা। পাহাড়ের প্রথম বেগম রোকেয়া পদকে ভূষিত হন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৪টি। গবেষকের দুই সন্তান ড. উএনু(প্রিয়াংকা/পুতুল), যাঁকে আমি দিদি বলে সম্বোধন করি ও চেনচেননু তুলি । তাঁরাও নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রতিষ্ঠিত।
0 Comments