মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
কাটারুং পাড়া (রাম রতন কার্বারী পাড়া) আমার জীবনের এক অনন্য নাম। গ্রামের নাম কাগজে কলমে রাম রতন কার্বারী পাড়া হলেও ত্রিপুরা সমাজে গ্রামটিকে সবাই বড় কাটারুং বলেই চেনে। লোকমুখে শুনেছি এই গ্রামের অনেক পুরনো ইতিহাস। এখানকার মানুষের অনেক সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা। কিন্তু সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই ছিলনা আমার।
এই গ্রামে থেকেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখা শেষ করেছিলাম। প্রাথমিকটা কোনমতে ছাড়তে পারলেও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনেকটা দূরে হওয়াতে যথেষ্ট পরিশ্রমও করতে হয়েছিল আমাকে। ৪০-৪৫ মিনিটের পথ ছিল। তবে কখনো কষ্ট মনে হয়নি তখন। শুধু বর্ষাকালে যখন মাইনী নদীর পানি বেড়ে গিয়ে পাড় ভরে যায় তখন নদী পার হওয়া এবং কাদা মাটির উপর দিয়ে একা একা জংগুলে পাহাড়ী পথে চলাচল করা খানিকটা দুষ্কর মনে হতো।
দিঘীনালা উপজেলার ২
নং বোয়ালখালী ইউনিয়নের ৩২ নং কাটারুং মৌজার সর্ব উত্তরে অবস্থিত গ্রামটি। গ্রামে যাওয়ার বিভিন্ন পথ থাকলেও উদাল বাগান থেকে ঠিক পশ্চিম দিকে মাইনী নদী পার হয়ে পায়ে হেঁটে ৪০-৪৫ মি: গেলেই ১২০-১৩০ পরিবারের এই গ্রামের সন্ধান মেলে।
আমার জন্মের কয়েক বছর পর ১৯৮৯ সালে এই গ্রামে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় আমাদের মাটির তৈরি একমাত্র আবাস গুদাম ঘরটি। তার আগেও দাদুর ভাতিজা
(বড় ভাইয়ের ছেলে) শান্তি বাহিনীতে যোগদানের অভিযোগে সেনাবাহিনীর সদস্যরা দাদুকে ধরে নিয়ে কখনো মারধর,
কখনো মাটিতে জ্যান্ত পুতে রাখা হতো,
কখনোবা দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে রেখে নানাভাবে নির্যাতন করতো দিনের পর দিন। পরবর্তিতে অগ্নিকান্ডে দিশেহারা গ্রামের সবার মতো আমাদেরকেও পালিয়ে যেতে হয়েছিল গভীর জঙ্গলে। কয়েক মাস পর আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন খাগড়াছড়ি শহরে বসবাস করার। বাবা কিনলেন একটা ছোট্ট বেড়ার ঘর বর্তমান খাগড়াপুরের নাইতং হাদুক অর্থাৎ হাদুক পাড়ায় । কোনমতে মাথা গুজাবার ঠাই হলো। যেখানে বাবা টিউশনি করে সংসার চালাতেন। টিউশনির যা টাকা পায় তাতে সংসার চলেনা তাই দিনগুলো কাটতে লাগলো আরো কষ্টে। কিন্তু কিছুই করার ছিলনা বাবার। উদ্বাস্তু হিসেবে জেলা পরিষদ থেকে কিছু চাউল পেলেও খাবার অযোগ্য ছিল সেগুলো। এভাবেই আমার পড়ালেখার বয়সটা পেরিয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। অপরদিকে দাদুরা আশ্রয় নিলেন দিবিপাড়া গুচ্ছগ্রামে দাদুর সহকর্মী তারিনী মাস্টারের বাড়িতে। সেখানে কিছুটা নিরাপদে থাকলেও আতঙ্কের সীমা ছিলনা। তবে দাদুর সাথে কথা বলে বাবা আবার সিদ্ধান্ত নিলেন পুরো পরিবার একসাথে থাকবে। তাই কয়েকবছরের মাথায় বাবা আবার আমাদের নিয়ে চলে এলেন দাদুর সাথে। দাদু যোগদান করলেন কাটারুংছড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা আমাকে ভর্তি করে দিলেন কাটারুংছড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানেই আমার বাল্যশিক্ষা ও
ধারাপাঠের যাত্রা শুরু। ইতোমধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে আমরা আবার ১৯৯৩-১৯৯৪ এর দিকে ফিরে এলাম নিজ ভূমিতে। বাবা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হলেন এবং বন্ধ হওয়া দাদুর বাবার নামে রাখা রাম রতন কার্বারী পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি পূনরায় চালু করলেন। দাদু এবার পোস্টিং নিলেন নিজ গ্রামে। অামিও ভর্তি হলাম ঐ
স্কুলে। এভাবে দাদুর কাছেই প্রাথমিক শিক্ষাটি শেষ করলাম। এরই মধ্যে মা, বাবা,
সীমা এবং আমি এই ছোট্ট পরিবারটি দাদুর বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেলাম এবং ৫
- ৬ মাসের মাথায় মাঝরাতে ডাকাতরা যা যা আছে সব লুৎপাত করে নিয়ে যায়। আমরা শুধু নিজেকে অসহায় ভেবে নিরবে সহ্য করে গেলাম।
মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি হলাম উদাল বাগান জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে (বর্তমান নাম উদাল বাগান উচ্চ বিদ্যালয়)। পড়লাম ভীষণ বিরম্ভনায়। না জানতাম বাংলা ভাল করে না জানতাম চাকমা ভাষা ভাল করে। শেষে দুটোই শিখতে হয়েছে একসাথে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ছিল সাংঘাটিক। তাই মাসে ২ বার হাসপাতালে নাগেলে ববোধহয় বাঁচতাম না। ভাগ্যিস এমএসএফ এর কোয়ারটেম ঔষুধটা খুবই কাজে দিয়েছিল। এভাবে কখনো জন্ডিস আর কখনো টাইফয়েড কখনো ম্যলেরিয়া লেগেই থাকতো সারা বছর জুড়ে। একসময় বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় সাংঘাতিকভাবে। একদিকে বাবার চিকিৎসা আরেকদিকে জমিগুলোর খন্ড রাখা দুটোই মুসকিলে পড়ে যাই আমরা। তাও আবার আমার টানা ৬ মাসের অসুস্থতার পর। তবে ততক্ষনে আমি সুস্থ হয়েছি। অল্প বয়সে মহিশের জোড়া দিয়ে কাদা মাটিতে হাল চাষ করা যে কত কষ্টের তা হারে হারে টের পেয়েছি। তবে মায়ের উপর বেশি বয়ে গেছে কষ্টের ভাগটা। সুভাগ্য আর দুর্ভাগ্য আর যাই হোকনা কেন আমরা যখন অষ্টম শ্রেণিতে পা রাখলাম ঠিক তখনই আমাদের জুনিয়র স্কুলের আগের ব্যাচের বড় ভাই-বোনেরা বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ পায়। তাই আমরাও বাবুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে রেজিস্ট্রেশন করি। এরই মধ্যে আবার অন্যের ঘরে থেকে পড়ালেখা করার অভিজ্ঞতাও অর্জন করে ফেলেছি। কারো কাছ থেকে পেয়েছি সহযোগিতা আর কারো কাছ থেকে নিন্দা। এভাবে মাধ্যমিক শেষ করলাম।
এস.এস.সি.র
পর এইচ.এস.সি.তে বড় মামা
(কিশোর/বাবুরাম)ও
মেঝ মামা(দিলীপ)
আমাকে গাছবান অমৃত পাড়ায় নিয়ে আসেন। যেখানে আমার নানি, বড় মামা, বড় মামি, ছোট মাসি, ছোট মামা, বড় মামার মেয়ে আমার ছোট বোন সাম্পিলি ছিল। মেঝ মামা পড়তেন ঢাকা কলেজে। আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো খাগড়াছড়ি সরকারী কলেজে। প্রতিমাসে ৩০০/-
থেকে ৪০০/-
পাঠানো হতো বাড়ি থেকে হাতখরচ হিসেবে। বাকী থাকা খাওয়া মামার বাড়িতে ফ্রি। কলেজ থেকে ৬ কিমি দূরে হওয়ায় এবং যানবাহনের অপ্রতুলতার কারণে বেশ আসা যাওয়া খানিকটা কষ্টের হলেও এই সময়টা ছিল খুব উপভোগের এবং আনন্দের। কেননা মামাদের পরিবারের অসীম সাপোর্ট,
মাঝে মাঝে মামাকে বিভিন্ন কাজে সহযোগীতা করা, গ্রামের ছেলেদের সাথে বিকালে খেলাধুলা করা, কলেজে বন্ধুদের সাথে টিএসএফ-এ
যোগদান ও
আড্ডা এবং পড়াশোনা করা বেশ স্বর্ণযুগই মনে হয়েছিল। ততক্ষণে আমার জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড সব ছেড়ে গিয়েছিল। এইভাবে শেষ করি এইচ.
এস. সি.। ততক্ষণে মেঝ মামা স্কলারসীপে চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। রেজাল্টের পূর্বে গিয়েছিলাম অচেনা শহর ঢাকায়। সেখানে পেলাম উজ্জল মামা,
রাজিব মামা,
খুমুই মামা,
রিটেন জ্যাঠা সহ আরো অনেককে। রেজাল্টের পর মেঝ মামাকে জনালে মেঝ মামা আমাকে ঢাকায় আসার জন্য উৎসাহ দেয়। তবে দুর্ভাগ্য জগন্নাথ হল ২০০৭ সালের নভেম্বরে জরুরী অবস্থার কারণে বন্ধ হয়ে গলে আশ্রয় নিই যাত্রাবাড়ির রিটেন জ্যাঠার কাছে। সেখানে থেকে যতটুকু সম্ভব ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করি। মামা অস্ট্রেলিয়া থেকে মানসিকভাবে ও
অর্থনৈতিকভাবে সাপোর্ট দিয়ে প্রেরণা যোগান। অনেক চড়াই উৎড়াইয়ের পর ভর্তি হতে সমর্থ হই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এখান থেকেই কখনো টিউশনি,
কখনো স্কুলের চাকুরী, কখনো বাবার সাপোর্ট,
কখনো BEST এর
সাপোর্ট, কখনো মামাদের সাপোর্ট, কখনো সমাজের বিভিন্নজনের সাপোর্ট নিয়ে পড়ালেখা শেষ করতে পেরেছি।
হয়তোবা হাতেগোনা গুটিকয়েক লোক বিভিন্নভাবে গ্রাম থেকে বেরিয়ে শিক্ষার আলো নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিছু একটা করে খাচ্ছেন কিন্তু অপরিবর্তিত রয়ে গেছে পুরো গ্রামটি। এখনো নেই পাকা অথবা ইটের রাস্তা, নেই বিদ্যুৎ, নেই কাছাকাছি একটা জুনিয়র স্কুলও, নেই যথেষ্ট পরিমানে নলকূপ, নেই অর্থনৈতিক অবস্থার অগ্রগতি। এমনকি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ও চলছে এখন প্যারা শিক্ষক (ভাড়া নেওয়া শিক্ষক) দ্বারা। এইভাবে ঝড়ে যাচ্ছে মাধাবী মুখগুলো। ক্রমশ কমছে শিক্ষিতের হার, বেড়েছে বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, মদ্যপান তথা দারিদ্র্যর জোয়ার। যেখানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষ হওয়ার স্বপ্ন কখনোই নিরাপদ নয়।
তবে সবশেষে মিনতি করি, কারো সাধ্য থাকলে কাটারুং পাড়া (রাম রতন কার্বারী পাড়া)র দিকে একটু সহযোগীতার হাত বাড়ান। প্রত্যন্ত এলাকা বলে শুধু প্রত্যন্ত করে রাখলেই প্রত্যন্তই থেকে যাবে আজীবন। তাই আমি আশাবাদী একদিন এই গ্রামের মানুষগুলো বিদ্যুৎ পাবে, ভাল স্কুল পাবে, ক্লিনিক পাবে, পাকা রাস্তা পাবে সর্বোপরি শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে দারিদ্র্যকে চিরদিনের মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে মাথা উচু করে দাঁড়াবে।
0 Comments