মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে যখন মানুষ নামের সৃষ্টির সেরা জীবের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা অবগত হই তখন থেকেই অজানা বিষয় তথা সৃষ্টির রহস্য এবং মানব সভ্যতা বর্তমান সময়ের মানুষের ভাবনাকে গভীর থেকে আরো গভীরতায় নিয়ে যায়। মানুষ ব্যকুল হয়ে উঠে সেসব রহস্যর দ্বার উন্মোচন করতে। কিন্তু সেখান থেকে জ্ঞাত হয়ে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা বা সাফল্যর মুখ হয়তোবা আজো কেউ দেখেনি। বড় বড় মহান দার্শণিকও নন। তবুও অনুসন্ধানী মন যেন এক অক্লান্ত পথিকের মতো ছুটে চলেছে বারংবার সৃষ্টির রহস্যের নেশায়। তেমনি রাঙ্গামাটির কতিপয় যুবক সৃষ্টিশীল ভাবনা নিয়ে খেলাধুলা তথা সমাজ কল্যানে মহান ব্রতী হয়ে ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি গঠন করেছিল ‘সৃষ্টি স্পোর্টিং ক্লাব’। মূলত ১৯৯৯ সাল থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হলেও আনুষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেছিল ২০০০ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড সম্পাদন করে প্রতিষ্ঠানটি হাটি হাটি পা পা করে শৈশব, কৈশর পেরিয়ে এই বছর পূর্ণ যৌবনের বয়স আঠারোতে পা রেখেছে। তাই যেমন বেড়েছে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রীক দায়িত্ব তেমনি বহুগুন বেড়েছে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব।
আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম জেলা রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই জেলার সুউচ্চ পাহাড়ের পাদদেশে কাপ্তাই লেকের নীলাভ জলধারা আবার অন্যদিকে ঝর্ণার সুরে বেজে উঠা পাহাড়ী গানের সুমধুর ধ্বনি যেমন মাতিয়ে দেয় সবার মনকে তেমনি সৃষ্টির বর্ষপূর্তিতে আজ মেতে উঠেছে পুরো রাঙ্গামাটি। নিজের যেকোন সৃষ্টির মাঝে যে অকৃত্রিম আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের ছৌঁয়ায় প্রাণ উৎফুল্ল হয়ে উঠে তা আজ সৃষ্টির প্রত্যেক সদস্যদের হৃদয়স্পন্দনে নির্ণিত। কেননা তারা যেমন স্বপ্ন দেখে তেমনি স্বপ্ন দেখায়ও । আর স্বপ্নের অস্তিত্ব আছে বলেই মানুষ বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পায়।
সৃষ্টির সাথে পরিচয় আমার বেশি দিনের না হলেও অন্তত বছর হিসেবেইতো গণনা করা যায়। কেননা সৃষ্টির খেলাধুলায় এগিয়ে থাকার গল্প যেমন অর্জনের তেমনি প্রতিষ্ঠানের সামাজিক কর্মকান্ডও বেশ নজর কেড়ে নেওয়ার মতো। খেলাধূলা, রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচানো, শীতের মৌসুমে শীতবস্ত্র বিতরণ, গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে ভর্তিতে সহায়তা, বিনামূল্যে বই বিতরণ, মানুষের যে কোন বিপদে এগিয়ে আসা , বাল্যবিবাহ রোধ , মাদক সেবন রোধ অর্থাৎ সম্পূর্ণ একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠানের কর্মকান্ড রাঙ্গামাটি শহরের প্রত্যেক মানুষের ঘুমন্ত চেতনাকে যেমন জাগ্রত করেছে তেমনি এগিয়ে যাওয়ার আরেকটি প্রত্যয়ে বেজে উঠেছে পরিবর্তনের সুর। প্রথমদিকে আমার অতীত জীবনের বেশ কিছু কর্মকান্ডের মিল এই সংগঠনের মাঝে খুঁজে পাওয়ায় আমি রীতিমতো হারিয়ে গিয়েছিলাম অতীতের স্মৃতিচারণে। কেননা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়ালেখার পাশাপাশি সামাজিক কর্মকান্ডগুলো আমাকে বেশ তাড়া করতো । তাই মুখ ফিরাতে পারিনি কখনো। TSF (Tripura Students’ Forum), ISA (Indigenous Students’ Association), PDF (Physically Challenged
Development Foundation ), Youth Ending Hunger, Dhoni ইত্যাদি নিতান্ত সামাজিক সংগঠনগুলোর সাথে কাজ করেছিলাম বলেই হয়তোবা এখনো প্রাণের টান হারিয়ে যায়নি । স্বপ্ন ছিল পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বহু থেকে আরো বহুদূর। দল বেধে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা মূলক সভা করতাম, শিক্ষার্থীদের সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবতাম, বিনা মূল্যে বই বিতরণের আয়োজন করতাম, প্রতিবন্ধী ভাই বোনদের সাথে বসে আড্ডা জমাতাম আর জানার চেষ্টা করতাম তাদের শারীরিক অসুবিধা তথা মানসিক অবস্থার কথা এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ক্ষেত্রে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিতাম যতটুকু সম্ভব। আবার কখনোবা ছুটে যেতাম বান্দরবনের থানচির রেমাক্রির মতো জায়গায় শীত বস্ত্র বিতরণে। আবার কখনোবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যেতাম অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়াতে। একবার রাত একটা বাজে গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার মতো জায়গায় গিয়ে পুলিশের সহায়তায় অপহরণকৃত ছাত্রীকে উদ্ধার করে তার বাবার কাছে তুলে দিয়েছিলাম। তবে সামাজিক কাজকর্ম মানেই আমাকে খুব টানতো ছাত্র জীবনে।
সৃষ্টি স্পোর্টিং ক্লাব রাঙ্গামাটিতে যেমন সকল মানুষের বন্ধু হয়ে কর্মকান্ড পরিচালনা করছে তেমনি আমি আশা করি এই সংগঠনের সীমানা শুধু রাঙ্গামাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা বরং বর্তমানের চলমান গতি অব্যাহত থাকলে ছড়িয়ে যাবে তাদের কর্মকান্ড সারা বংলাদেশ তথা বহির্বিশ্বে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু বিষয়গুলোর উপর নজর দেওয়া খুবই জরুরী । তবে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা যেমন সহজ কাজ নয় তেমনি অতি কঠিন কাজও নয়। তাই যে বিষয়গুলো থাকলে একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা ও এগিয়ে যাওয়া সম্ভব সেগুলো হল:
১. লক্ষ্য নির্ধাারণ করা: একটি সংগঠনের কর্মীদের প্রথম ও প্রধান করণীয় কাজ হল সংগঠনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা। লক্ষ্য বিহীন জীবন যেমন সময় কাটানো তেমনি লক্ষ্যবিহীন সংগঠনও ভাসমান শুকনো পাতার মতো। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে চলা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা তার। তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকলে সংগঠন যেমন গতিশীল থাকে তেমনি
২. দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা: একটি সংগঠন পরিচালনা তথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে বিষয়টি অতি জরুরী সেটি হল দক্ষ নেতৃত্ব গড়ে তোলা। কেননা দক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া একটি সংগঠন মাঝিবিহীন নৌকা চলার মতো । যেমন গাড়ীর ড্রাইভার যদি দক্ষ না হয় তাহলে যাত্রীবোঝায় গাড়িটি যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনায় পর্যবসিত হতে পারে তেমনি দক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া একটি সংগঠন সমাজের জন্য ক্ষতির কারণও হতে পারে । তাই সংগঠনে দক্ষ নেতৃত্বের কোন বিকল্প নেই।
৩. ঐক্য গড়ে তোলা: সামাজিক সংগঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা। কথায় আছে- “ একতাই বল” । যেকোন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যদি সকল সদস্য একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে তাহলে অবশ্যই সে পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হতে বাধ্য।
৪. সঠিক ও সুপরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ: পরিকল্পনা যদি সঠিক ও সুপরিকল্পিত না হয় তাহলে যে কোন সময় হোচৎ খাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই সমাজ বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে নিজ সংগঠনের সাধ্য অনুযায়ী সঠিক ও সুপরিকল্পিত কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। যা ষাৎমাসিক, বাৎসরিক, দ্বিবার্ষিকী এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও হতে পারে।
৫. যোগাযোগ অব্যাহত রাখা: যে কোন বিষয়ে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ তথা সংগঠন সংশ্লিষ্ট যে কোন বিষয়ে যে কারো সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে পারলে সংগঠনের কার্যক্রমে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও বর্তমানে যে কোন কাজের অগ্রগতিতে যোগাযোগের কোন বিকল্প নেই।
৬. অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্তিশালী করা: সংগঠনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো অর্থ। কেননা অর্থ না থাকলে যে কোন কাজ সম্পাদন করা খুবই হিমসিম খেতে হয়। তাই অর্থনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরী। এক্ষেত্রে মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়ী মনোভাব এবং তহবিলে অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা নিরন্তর অব্যাহত রাখতে হবে।
৭. প্রত্যেক সদস্যের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা: সংগঠনের মূল হাতিয়ার সদস্যবৃন্দ। তাই সংগঠনের যে কোন কাজে সকল সদস্যর সক্রিয় অশগ্রহণ যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে সে সংগঠন উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে এটি নিশ্চিত।
৮. সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া, সৎ থাকা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়া: সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যকে অবশ্যই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে এবং সৎ ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। তবে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য শুধুমাত্র বড় কোন উচ্চশ্রেণির সার্টিফিকেট অর্জন করলেই হবেনা তাতে মানবিক মূল্যবোধ, সততা, ভাতৃত্ববোধ ইত্যাদি গুণের অধিকারী হতে হবে।
৯. শাখা কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা: সামগ্রিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় কার্য্যালয়ের অধীণে বিভিন্ন জায়গায় অথবা অন্যান্য জেলাগুলোতে সংগঠনের শাখা কার্যালয় খোলা যেতে পারে যাতে সমগ্র বাংলাদেশে কাজ করার সুযোগ তৈরি করা যায়।
১০. সামাজিক উন্নয়নের চিন্তাধারা অব্যাহত রাখা: একটি সামাজিক সংগঠনের মূল লক্ষ্যের একটি অন্যতম লক্ষ্যই হল সামাজিক উন্নয়ন। সংগঠনের প্রত্যেক সদস্যদের চিন্তা চেতনায় অবশ্যই সমাজের বিভিন্ন বিষয়গুলোর স্থান দিতে হবে। ভাবতে হবে কিভাবে গুণে ধরা সমাজকে সমস্ত জঞ্জাল থেকে মুক্তি দিয়ে একটি সুস্থ ও সুন্দর সমাজ নির্মাণ করা যায়।
১১. বিভিন্ন গুণীজন ও উপদেষ্টা মন্ডলীর সুপরামর্শ গ্রহণ: সংগঠনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম পন্থা হলো বিভিন্ন গুণীজন ও উপদেষ্টামন্ডলীর সুপরামর্শ গ্রহণ । সমাজে এমন সব গুণীজন এখনো বেঁচে আছেন যাদের একটি কথা বা একটি পরামর্শ এখনো সমাজ পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
উপরোক্ত বিষয়গুলো আলোচনা করলাম শুধু একটি সংগঠনের প্রাথমিক ভিত্তিটাকে শক্তিশালী করার জন্য যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সেগুলো নিয়ে। যাহোক স্বপ্নময় জীবন যেমন কখনো থেমে থাকেনা ঠিক তেমনি সামাজিক চিন্তাধারায় প্রতিষ্ঠিত সংগঠনগুলোও কখনো পেছনে ফিরে তাকায়না। সে এগিয়ে যাবেই। তাই সৃষ্টির প্রত্যেক সদস্যদের আমি শুধু এই আহবানটুকু করতে চাই, “যত ঝাড় ঝঞ্চাই আসুক না কেন হাল ছেড়োনা বন্ধু সাফল্য তোমার আসবেই” ।
বর্তমানে আমাদের দেশে সামাজিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা সামাজিক সংগঠনই পারে তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে একটি সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এমনকি সমাজের ভেতরের রূপ বদলে দিতে। মানব সভ্যতা যেমন একদিনে তৈরি হয়নি তেমনি একটি সুন্দর সমাজ গঠন করাও একদিনের কাজ নয়। তার জন্য নিতে হবে সময়, ধরতে হবে ধৈর্য এবং প্রচেষ্টা থাকবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের বাস্তবায়নে। তাহলেই একদিন সৃষ্টি শুধু বাংলাদেশে নয় বিশ্বের দরবারে একটি স্বনামধন্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই গড়ে উঠবে এটিই আমার প্রত্যাশা।
0 Comments