বাংলাদেশের ত্রিপুরাগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য তীর্থস্থানের নাম মাতাই পুখিরি। খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলাস্থ নুনছড়ি মৌজায় অবস্থিত সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে প্রায় ১৫০০ ফুট উপরে প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে বিদ্যমান প্রাকৃতিক হ্রদ মাতাই পুখিরি। যুগ যুগ ধরে এই হ্রদটি ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর নিকট মাতাই পুখিরি নামেই বেশ পরিচিত। নামকরণের ক্ষেত্রে মাতাই পুখিরি শব্দটি ককবরক ভাষা থেকে গৃহীত। মাতাই অর্থ দেবতা এবং পুখিরি অর্থ পুকুর। অর্থাৎ শাব্দিক অর্থে মাতাই পুখিরি অর্থ দেবতা পুকুর। তাই অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নিকট এই হ্রদটি কখনো কখনো দেবতা পুকুর নামেও পরিচিতি লাভ করেছে। এই মাতাই পুখিরির অবস্থান খাগড়াছড়ি জেলা শহর থেকে ১২ মাইল দক্ষিণ পশ্চিম খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সড়কের পশ্চিমে ২৫৭ নং নুনছড়ি মৌজায়।
পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি ভাবে শুয়ে থাকা এই পবিত্র জলশয়টি দৈর্ঘে প্রায় ১৫০০ ফুট এবং প্রস্তে প্রায় ৬০০ ফুট। চারিদিকে পাহাড় বেষ্টিত এই জলাশয়টির পানি স্বচ্ছ ও পরিস্কার এবং সুউচ্চ পর্বতের শিখরে অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও মাতাই পুখিরির পানি কখনো শুকায় না। তীর্থক্ষেত্র মাতাই পুখিরিতে ত্রিপুরা আবাল বৃদ্ধ বণিতা সবাই হারি বৈসুক এর দিনে বিভিন্ন রোগ ব্যাধি ও মহামারি থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ¯œান করতে যায়, শান্তির পায়রা উড়িয়ে দিতে যায় এবং মানত অনুযায়ী বিভিন্ন পূজা দিতে যায়।
এই প্রাকৃতিক জলাশয়টির গভীরতা নিয়ে রয়েছে নানা লোকশ্রুতি। কথিত আছে, রেবতী রঞ্জন নামের জৈনক হিন্দু ভদ্রলোক স্থানীয় লোকদের সাহায্যে বাঁশের ভেলায় চড়ে এই হ্রদের মাঝখানে গখভীরতা মাপার চেষ্টা করেন। কিন্তু দড়ি তল পর্যন্ত ঠেকাতে পারেননি। বরং ভেলাসহ ডুবে যাং যাং অবস্থা হওয়াতে একটা ছাগল মানত করে গভীরতা নির্ণয়ের চেষ্টা ত্যাগ করেন।
এই প্রাকৃতিক হ্রদকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রয়েছে নানা লোককাহিনী । সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রকৃতি পূজারী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিশ^াস অলৌকিক কোন শক্তির প্রভাব রয়েছে বলেই হ্রদটি উঁচু একটি পাহাড়ে সৃষ্টি হয়েছে এবং এই হ্রদের জল কখনো শুকায় না। অনেকের বিশ^াস স্বয়ং জলদেবতা স্থানীয় গ্রামবাসীদের পানির চাহিদা মিটানোর জন্য এই হ্রদ সৃষ্টি করেছেন। তাই স্থানীয়দের নিকট এই হ্রদ আশীর্বাদস্বরূপ।
হ্রদের চারদিক ঘন বন ও মালভূমি দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় এই হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে এর উচ্চতা অনুভব করা যায় না। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা তীর্থযাত্রীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির মানুষের সমাগম ঘটে এই হ্রদে। ত্রিপুরাদের বিশ^াস এই হ্রদে স্নান করলে এবং নানা মানত করলে মনোবাসনা পূরণ হয় এবং নানা রোগ ব্যাধি হতে মুক্তি পাওয়া যায়। ত্রিপুরাদের নিকট হ্রদটি একটি তীর্থস্থান। অনেকের ধারণা পুরাকালে এই হ্রদটি স্বয়ং দেব-দেবীরা রক্ষণাবেক্ষন করতো এবং সবসময় পাহারা দিয়ে রাখতো। বিবাহসহ সামাজিক বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নের জন্য এ হ্রদের পাড়ে এসে পবিত্র মন নিয়ে প্রার্থনা করলে সোনার বাসন কোষন পানির উপর ভেসে উঠতো। সামাজিক কাজ সম্পন্নকরে গ্রামবাসীরা শপথ ভঙ্গ করে হিসেব মতে বাসন ফিরিয়ে না দেওয়ার পর থেকে দেবতারা রুষ্ট হয় এবং আর গ্রামবাসীদের বাসন কোষন দেওয়া বন্ধ করে দেয় বলে কথিত রয়েছে।
অন্য এক প্রচলিত বিশ^াস মতে, পুরাকালে এই পাহাড়ে পাশাপাশি দুইটি ত্রিপুরা লোকালয় ছিল; উদয় কার্বারী পাড়া ও ধন্য কার্বারী পাড়া। উদয় কার্বারী পাড়ার জনৈক বাসিন্দা একসময় এক পাহাড়ে জুমচাষের উদ্যোগ নেন। এ সময় তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেওয়া হয় এই পাহাড়ে জুম চাষ না করার জন্য । কিন্তু জুমিয়া ব্যক্তিটি সেই স্বপ্নাদেশ আমলে না নিয়ে জুম চাষ করেন। স্বপ্নে বার বার তাকে নিষেধ করা হয়। শেষে যখন জুমের ফসল তোলার সময় আসলো তখন তিনি আবারও স্বপ্নাদিষ্ট হলেন। তখন তাকে নরবলি দিয়ে তবেই জুমের ফসল কাটার জন্য আদেম দেওয়া হয় এবং নরবলি দেিয় জুমের ফসলের পাশাপাশি আরও কিছু ধনলাভ করবেন বলেও স্বপ্নে জানানো হয়। কিন্তু এই শর্ত পূরণ করা জুমিয়া কৃষকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর কিছুদিন পর এক অমাবশ্যা রাতে সেখানে এক প্রলয়ংকারী ভূকম্পন দেখা দেয়। সকালে উঠে সকলে দেখতে পায় , সেখানে জুমের পরিবর্তে এক বিশাল জলাশয়।
অন্য এক প্রচলিত লোকস্মৃতি ঘিরে রয়েছে ধন্য কার্বারীর এক ষোড়শী কন্যাকে নিয়ে। জানা যায়, ধন্য কার্বারীর ষোড়শী কন্যা একদিন কলসী কাঁখে একাকিনী ভরদুপুরে জল তুলতে গিয়ে দেখতে কপায় জলাশয়টি পুরো জলশূন্য হয়ে রয়েছে এবং গভীর খাদে জলাশয়টির মাঝ বরাবর দুইটি সিন্দুক রোদে ঝকমক করছে। সে কৌতুহলবসে পাড়ায় গিয়ে তার মা বাবাকে বিষয়টি বলে। কিন্তু সকলে এসে দেখতে পায় জলাশয়টি আগের মতোই জলে ভরা। এরপর থেকে কার্বারীর কন্যা প্রতি রাতে স্বপ্নে দেখতে থাকে , কোন এক সুন্দরী দেবী তাকে তার সাথে যাওয়ার জন্য ডাকছেন। বার বার দেবীর আদেশ পেয়ে ষোড়শী কন্যা একদিন সুবাসিত তেল মেখে , বনো ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে খোঁপা সাজিয়ে মা বাবা , আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হ্রদের জলে নেমে যায়। পাড়াবাসীরা অবাক হয়ে দেখলো , মুহূর্তে এক পরীর মতো পরমা সুন্দরী নারী এসে তাকে কোলে করে জলাশয়ের মাঝখখানে চলে গেল। জল যেন তখন দুভাগ হয়ে তাদের রাস্তা করে দিল। অশ্রুসজল চোখে গ্রামবাসী সকলে এই দৃশ্য অবলোকন করলো।
এই জলাশয়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক একটি ঘটনা লোকমুখে এখনো প্রচলিত। দিনটি ছিল চৈত্রসংক্রান্তির দিন। এখানে উল্লেখ্য যে , প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তির সময় এখানে মেলা বসে। পূণ্যার্থীরা সমবেত হয়ে মনোবাসনা জানিয়ে নানা পূজো আর্চনা করার জন্য। সবে পূজো আচার শেষ হয়েছে অমনি জলাশয়ের মাঝ বরাবর জল সশব্দে নেচে উঠে। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই এই পরমাসুন্দরী জলকন্যা জলের উপর কোমর পর্যন্ত ভেসে উঠে এবং মুহূর্তে আবার জল অদৃশ্য হয়ে যায়। এ সময় উপস্থিত সকলে এ দৃশ্য অবলোকন করে।
আরো একটি জনশ্রুতি মতে, সেখানে এক বিধবা নারী বাস করতেন। একদিন গ্রামের শেষ প্রান্তের বটগাছের কোঠর হতে মস্তবড় এক অজগর সাপ পেয়ে গ্রামবাসী সকলে মহাভোজে মেতে উঠে। মহাভোজকালে তারা দরিদ্র বিধবাকে নিমন্ত্রণ করতে ভুলে যায়। রাতে দরিদ্র বিধবার স্বপ্নে এক দেবতা এসে তাকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলে। কারণ শেষ রাতে এই গ্রামে একটি অঘটন ঘটবে। দেবতার আদেশ অনুযায়ী বুড়ি গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেন। ভোর রাতে তিনি বিকট আওয়াজের বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান। সকালে গিয়ে দেখেন পুরো গ্রাম একটি সরোবরে পরিণত হয়েছে। সকল গ্রামবাসী নিদ্রামগ্ন অবস্থায় এই সরোবরে মিলিয়ে যায়।
0 Comments