মুকুল কান্তি ত্রিপুরা
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয়ের মাসের আজকের দিনটি ছিল সত্যিই একটি শোকাবহ দিন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঊষালগ্নে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণার দিন। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের কলঙ্কিত একটি দিন এই ১৪ ডিসেম্বর । তাই দিনটি এদেশের মানুষের নিকট এখনো পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে। তাই আজকের এই দিনে আমি প্রথমেই দেশের সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জানাচ্ছি বিন¤্র শ্রদ্ধা।
এখন প্রশ্ন হলো এই বুদ্ধিজীবী কারা এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁরা কিভাবে অবদান রেখেছিল?
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যারা দৈহিক শ্রমের বদলে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দেন তারাই বুদ্ধিজীবী। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো:
“বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কন্ঠশিল্পী, সকল পর্যার্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী।”
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ সাংবাদিক, ৪৯ চিকিৎসক, ৪২ আইনজীবী এবং ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক-প্রকৌশলী।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বুদ্ধিজীবীরাও অনন্য অবদান রেখেছিল। যেমন- ভারতে আশ্রয় নেয়া বুদ্ধিজীবীরা গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’ যার সভাপতি ছিলেন ড. আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। এছাড়া তাকে সভাপতি এবং জহির রায়হানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয়েছিল ‘বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ’। বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন মুজিবনগর সরকারের অধীনে পরিকল্পনা সেল গঠন করেন। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সরবরাহ ও বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদীয় পার্টির সঙ্গে সাক্ষাৎ, সাহায্যের আবেদন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য প্রদান, শরণার্থীদের উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে তারা অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন। শরণার্থী শিবির শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে ৫৬টি স্কুল খুলে শরণার্থীদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন তারা। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীদের প্রেরণার উৎস ছিল। এভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে ব্যপক অবদান অবদান রাখেন।
তবে তাদের ভূমিকা শুধু যুদ্ধের নয় মাসেই সীমিত ছিল না। ব্রিটিশ আমলে পরাধীনতার বিরুদ্ধে পরবর্তীকালে জাতির অধিকার আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তারা ছিলেন অনুপ্রেরণাদানকারী।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, ৪৮ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানীদের অধীনস্ত রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মেতে উঠেছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের শেষলগ্নে জাতি যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই ১৪ ডিসেম্বরে বাঙালি মেধার নৃশংস এই নিধনযজ্ঞ যা বিশ্বকে হতবিহবল করে তুলেছিল । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল পরাক্রমের সামনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসররা।
এখন প্রশ্ন হলো পাকিস্তানীরা কেন ঘটিয়েছিল এই হত্যাকান্ড? পাকিস্তান নামক অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই বাঙালিদের বা পূর্ব-পাকিস্তানীদের সাথে পশ্চিম-পাকিস্তানের রাষ্ট্র-যন্ত্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। তারা বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে এবং বাঙালিরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এ সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক-ভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তা-বোধে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এজন্য শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানী বাহিনী বাছাই করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। এছাড়া যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন পাকিস্তানের পরাজয় যখন শুধু সময়ের ব্যাপার তখন বাঙালি জাতি যেন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে তাই তারা বাঙালি জাতিকে মেধা-শূন্য করে দেবার লক্ষ্যে তালিকা তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। তারা বেছে বেছে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য মানুষের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করেছিল রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির সদস্যরা।
বিজয় অর্জনের পর রায়েরবাজারের পরিত্যক্ত ইটখোলা, মিরপুরসহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে একে একে পাওয়া যায় হাত-পা-চোখ বাঁধা দেশের খ্যাতিমান এই বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। এসব মৃতদেহ পাওয়ায় উন্মোচিত হয় ঘাতকদের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা। এ ঘটনায় বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। এই শহীদ বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকবেন দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে।
[বি. দ্র.: লেখাটি বাংলাদেশ বেতার রাঙ্গামাটিতে প্রচরারিত হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস উপলক্ষে]
0 Comments