শুধু করোনা নয় উচ্ছেদ আতঙ্কেও দিন কাটে তাঁদের


মুকুল কান্তি ত্রিপুরা

কিশোরী সুকলটি ও ছবিরাণীর কথা আপনাদের মনে পড়ে কি? যাঁদের সজীব প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল পাষন্ড কিছু নরপশু। এমন লোমহর্ষক নৃসংশ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশের মানবতাবাদী সমাজ তুলেছিল বজ্র কন্ঠস্বর।  মনে পড়ে, তথাকথিত অজ্ঞাত রোগের নামে চিকিৎসা না পেয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল কোমলমতি কতিপয় শিশু? অথচ ঐ অজ্ঞাত রোগটি ছিল অতি পরিচিত ‘হাম’। হ্যাঁ, নিশ্চয় মনে পড়ার কথা। কারণ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন আলোচিত ঘটনাগুলো অত সহজেই ভুলে যাওয়ার নয়। শুধু তাই নয়, এমন আরো অনেক উদাহরণ নিজভূমে পরবাসী এই অসহায় জনগোষ্ঠীর জীবনকে করে তুলেছে অনেক বেশি দুর্বিসহ। সীতাকুন্ডের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামের ক্যানভাসে চিত্রিত এমন অপ্রত্যাশিত চিত্রগুলো নিঃশ্চয় নাড়া দেয় আমাদের মানবতার বিবেককে বারংবার। আর অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে পরিবেশের বিপর্যয় তথা বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব যে সারা বিশে^র মতো আমাদেরকেও  ভাবনার খোরাক যুগিয়ে দেয় তা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য। তেমনি একটি উচ্ছেদ প্রক্রিয়া ও পরিবেশের হুমকীর কথা জানার সুযোগ হয় বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকের বিগত ১৭ এপ্রিল ও ১৮ এপ্রিল এসএ টিভি(SATV) এর পেইজে আপলোডকৃত চট্টগ্রামের সোহাগ কুমার বিশ্বাসের করা রিপোর্টগুলোর মাধ্যমে। 

বাংলাদেশ তথা সারা বিশ^ যখন করোনা ভাইরাস বা ‘কোভিড-১৯’ মোকাবিলায় হিমসিম খাচ্ছে ঠিক তখনই উচ্ছেদ  আতঙ্ক যেন ছাড়িয়ে গেছে করোনার আতঙ্ককেও। যেখানে নিজের যুগ যুগ ধরে বসবাসের একমাত্র সম্বল ভিটেমাটিটুকু হারিয়ে যাযাবর হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটছে সেখানে অদৃশ্য করোনা ভাইরাস নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগইবা কোথায়? বরং দিনমজুরীর উপর চলা এমন অসহায় মানুষগুলো একদিকে খাবারের সংকট অন্যদিকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্কে পার করছে এ মহাসংকটময় সময়টি। জিপিএইচ ইস্পাত (GPH Ispat Ltd.কোম্পানির কারখানা সম্প্রসারণের নামে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার ৭নং কুমিরা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সুলতানা মন্দির ত্রিপুরা পাড়ার যুগ যুগ ধরে বসবাসরত প্রায় ৩০ টি পরিবারকে উচ্ছেদ  প্রক্রিয়ার ঘটনা নিয়ে বিগত ১৭ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে প্রচারিত এসএ টিভির একটি রিপোর্ট ব্যাপক নজরে আসে দেশবাসীর। এই রিপোর্টে সুলতানা মন্দির পাড়ায় অবস্থিত জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড(GPH Ispat Ltd.) কর্তৃক প্রায় ৩০ টি ত্রিপুরা পরিবারকে উচ্ছেদের নানা কৌশল অবলম্বনের কথা তুলে ধরা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী বলা যায়, প্রথমেই কোম্পানির লোক জায়গাটি কোম্পানীর ক্রয়কৃত জায়গা বলে দাবী করে এবং গ্রামবাসীদের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটিও দখল করে নেয় । অতঃপর গোসলের জন্য ব্যবহৃত একমাত্র পুকুরে পাড়ার লোকদেরকে নামতে নিষেধ করা হয়। যেখান থেকে খাবারের পানির যোগান আসতো সেখানেও দেওয়া হয় কারখানার বাঁধ। কোম্পানী কর্তৃক ত্রিপুরা পাড়ার ভেতরেই বসানো হয় কারখানার ওয়াচ টাওয়ার। রিপোর্টে পাড়াবাসীদের প্রতিক্রিয়াতে উঠে আসে হতাশার আস্ফালন। আসলেইতো যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসা এই মানুষগুলো যাবে কোথায়?  এমনকি রিপোর্টারের ভাষ্যমতে বাস্তবতা আরো নির্মম। আরেকটি বিষয় লক্ষনীয় যে, এসএ টিভির রিপোর্টার যখন ত্রিপুরা পাড়ায় যাওয়ার চেষ্টা করে তখন কোম্পানীর লোকদের দ্বারা বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। যদিও পরবর্তীতে কোম্পানীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতিতে  কোম্পানীর গার্ডদের সাথে নিয়ে প্রবেশের সুযোগ পায়। তাহলে একবার ভাবুন না কতটা অবরুদ্ধ জীবন তাঁদের। হঠাৎ করে নাই হয়ে গেছে দীর্ঘ বছরের হাটার পথ। অথচ বর্তমান সরকার যেখানে দেশের সকল জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করে যাচ্ছে সেখানে একটি কোম্পানি অবরুদ্ধ করে রেখেছে পুরো গ্রামটি।  গোসলের একমাত্র উপায় পুকুরটিতেও  আর নামতে পারবে না পাড়াবাসী। তাহলে দৈনন্দিন অতি প্রয়োজনীয় এই গোসলের জন্য তারা যাবে কোথায়? অথচ বর্তমানে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য সবসময় হাত ধৌয়ার এবং পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ তথা সরকারের পক্ষ থেকে।  আর খাবারের পানিও আনতে পারবে না এই গ্রামবাসী, কারণ তাঁদের খাবারের পানি সংগ্রহ করার একমাত্র অবলম্বন যেখানে সেখানেই কোম্পানী কর্তৃক বাঁধ দিয়ে ফেলা হয়েছে। আর কর্মহীন এমন সংকটময় সময়ে তাঁদের আহারের যোগান দিতে কয়জনইবা এগিয়ে এসেছেন? তাহলে এই মানুষগুলোর অস্তিত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন প্রশ্ন স্বভাবতই এসে যায় যে কোন বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে। আর ঘটনাটি শোনার পর বা দেখার পর একজন বিবেকবান মানুষের স্বাভাবিকভাবেই মনে হওয়ার কথা যে, বর্তমানে অতিপরিচিত লকডাউন শব্দটি বোধহয় এখানে অন্যভাবে কার্যকর রয়েছে, যে পরিস্থিতিকে পানিবিহীন ও আহারবিহীন এক নতুন রূপের লকডাউনের সাথে তুলনা করা যায়। তবে ১৮ এপ্রিলের রিপোর্টে দেখা যায়, কোম্পানীর এমন অপরিকল্পিত শিল্পায়নের কার্যক্রমকে জনবসতি ও পরিবেশের জন্য হুমকীস্বরূপ মনে করে বিভিন্ন মহল জরুরী ভিত্তিতে বন্ধের দাবী জানায়। 

তাহলে ঐ পুরো পাড়াটি যদি কোম্পানীর দখলে চলে যায় এর পরিণাম কি হতে পারে? প্রথমত, ইস্পাত কোম্পানী চেষ্টা করবে তার কারখানাকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরো সমৃদ্ধ করার । এই প্রচেষ্টাই পাড়াবাসীকে অন্যত্র কোথাও চলে যেতে বাধ্য করবে। যদিও আপাতত তাদের অন্যত্র যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তবুও যদি যেতেই হয় তাহলে হারিয়ে যাবে যুগ যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা আর্থ-সামাজিক অবস্থা(যতটুকু আছে), চতুর্দিক থেকে পড়বে এক মহাসংকটে, পরিণত হবে যাযাবর শ্রেণিতে, অস্তিত্ব বলতে আর কিছুই থাকবে না, যেটাকে বলা যায় শিল্পায়নের নামে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। দ্বিতীয়ত, পরিবেশের ব্যপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। পাহাড়ের যে মানুষগুলো প্রকৃতির নিজস্বতাকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন যাপন করে আসছে সে মানুষগুলো সেখান থেকে চলে যাওয়া মানেই সেখানে নিঃসন্দেহে পাহাড় কেটে গড়ে উঠবে ইট, বালি, কংকর বা লোহার এক বিরাট শিল্পকারখানা, তখন হুমকীর সম্মুখীন হতে পারে জীববৈচিত্র্য বা পরিবেশের ভারসাম্যেরও। তাই অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে বৈশি^ক উষ্ণতা নিয়ে এবং চলমান করোনা ভাইরাস নিয়ে যেখানে বাংলাদেশ তথা সারা বিশ^ থমকে আছে, সেখানে কোম্পানীর প্রকল্পের নামে এভাবে অসহায় প্রকৃতির সন্তান সাধারণ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর উপর উচ্ছেদের মহাযজ্ঞ চালানোর প্রক্রিয়াটি বিংশ শতাব্দীর এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অমানবিক দৃষ্টান্ত নয় কি? নাকি সীতাকুন্ডের ত্রিপুরাদের নিজভূমে পরবাসী হওয়ার এমন অসহনীয় চিত্র নিয়তির লিখন? 

এদিকে বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস অর্থাৎ কোভিড-১৯ এর আক্রমণে দেশের সমগ্র জেলা কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। যেন অনেক প্রচেষ্টার পরও থামানো যাচ্ছে না কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। দিন দিন উর্দ্ধগতিতে বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তাই জনমনে এক প্রকার মহা আতঙ্ক বিরাজ করছে। থমকে গেছে পুরো দেশের অর্থনীতির চাকা। শুধু তাই নয় করোনার প্রভাবে দেশের সবকিছুতেই একটি অচলাবস্থা তৈরি হতে চলেছে। যেখানে সরকার ও ত্রাণকর্তারা কর্মহীন মানুষদের ত্রাণ দিয়ে সংকুলান করতে পারছেনা ।  ঠিক এমনই এক মহা সংকটময় সময়ে সীতাকুন্ডের সুলতানা মন্দির ত্রিপুরা পাড়ার অবস্থাও নাজেহালই বলা চলে। কেননা তাদের অধিকাংশ মানুষের আয়রোজগার একমাত্র শারিরীক শ্রমের বিনিময়ে অর্থাৎ এক কথায় দিনমজুর বা সাধারণ খেতে খাওয়া মানুষ। তাই চারিদিকে কাজকর্ম বন্ধ, আর কাজকর্ম নেই মানে আয়রোজগারও নেই। কিছুদিন পর দুর্ভিক্ষ নেমে আসার সম্ভাবনাও একেবারেই অমূলক নয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে উচ্ছেদের প্রক্রিয়ার ভার সামলানো এই সহজ সরল ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জন্য সত্যিই কঠিনতম একটি কাজ।

যাহোক, একটা বিষয় লক্ষনীয় যে করোনার এমন পরিস্থিতিতেও এই ঘটনাটি নিয়ে দেশের বিভিন্ন মহলে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে নানা আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিভিন্ন মানবতাবাদী ও পরিবেশবাদী সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসেছে এই ত্রিপুরা পরিবারগুলোর সুরক্ষার প্রয়োজনে।  দেখা যায় বিগত ১৯ এপ্রিল, ২০২০ বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান ছাত্র সংগঠন ‘ত্রিপুরা স্টুডেন্টস’ ফোরাম, বাংলাদেশ’ এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। সংগঠনের সভাপতি প্রেম কুমার ত্রিপুরা ও সাধারণ সম্পাদক নক্ষত্র ত্রিপুরার যৌথ স্বাক্ষর সম্বলিত এই প্রতিবাদপত্রে সরকারের নিকট ৬ টি গুরুত্বপূর্ণ দাবিও পেশ করা হয়েছিল। যেমন, দাবিগুলো হল- ১) সুলতানা মন্দির ত্রিপুরা পাড়ায় বসবাসরত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীকে “জিপিএইচ ইস্পাত(GPH Ispat) কোম্পানী লিমিটেড” কর্তৃক উচ্ছেদ প্রক্রিয়া দ্রুত বন্ধ করতে হবে; ২) স্থানীয় ত্রিপুরাদের নামে ভূমি বন্দোবস্তী প্রদান করতে হবে; ৩) তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; ৪) রাস্তাঘাট ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে; ৫) তাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে ও ৬) ত্রিপুরাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরাম কর্তৃক উত্থাপিত এই দাবিগুলো খুবই যুক্তিসংগত মনে করি এবং এটাও আশা রাখি যে, ছাত্রদের এমন দাবিকে নিছক কোন ছেলে খেলার আসর ভেবে কেউ উপেক্ষা করবেননা বরং কর্তৃপক্ষ গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে বাস্তবায়নের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। তবে শুধু যে ছাত্ররা এগিয়ে এসেছে তা নয়, বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর প্রধান অভিভাবক সংগঠন ‘বাংলাদেশ ত্রিপুরা কল্যান সংসদ’ও বিগত ২০ এপ্রিল ২০২০ তারিখে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনন্ত ত্রিপুরার স্বাক্ষরিত এক আবেদন পত্রের মাধ্যমে চট্টগ্রামের মাননীয় জেলা প্রশাসকের নিকট বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করেন। তাঁদের দাবিগুলোতে রয়েছে -১) পাড়াবাসীদের উচ্ছেদ হতে হয় এমন কার্যক্রম বা প্রকল্প বাতিল করতে হবে; ২) পাহাড়বাসীদের নামে তাদের বসতভিটা, ছড়া ও পুকুর বন্দোবস্তি প্রদান করতে হবে; ৩) পাড়ায় যাতায়াতের সকল রাস্তা পাড়াবাসীদের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে; ৪) পাড়াবাসীদেরকে সকল মৌলিক সুবিধা ও সরকারি সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে ও ৫) পাড়াবাসীদের সার্বিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এই আবেদন পত্রের একটি বিষয় খুবই পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয় সেটি হল- “এই ত্রিপুরা পাড়ায় প্রায় ৩০টি পরিবার রয়েছে, যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই প্রায় ৫০ বছরের বেশি সময়কাল ধরে বসবাস করে আসছে। এতদিন তাদের বসতি নিয়ে কোন পক্ষ থেকে কোনরূপ অভিযোগ কিংবা আপত্তি তুলেনি এবং এই জায়গার মালিকানা নিয়েও দাবি করেনি, কিন্তু প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় পরে বর্তমান সময়ে এসে তাদেরকে জানানো হয় , তাদের বসতভিতা ও পাহাড়সহ পুরো এলাকাটি জিপিএইচ ইস্পাত নামের একটি কোম্পানি কিনে নিয়েছে।” উক্ত সংগঠনগুলো ছাড়াও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আরো অনেক সংগঠন ও মানবতাবাদী বা পরিবেশবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো । যেমন- বিগত ২০ এপ্রিল ২০২০ তারিখের ‘জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল’, চট্টগ্রাম জেলার পক্ষ থেকে সভাপতি ও সদস্য সচিব সামিউল আলম ও ভিকি মজুমদার এর যুক্ত বিবৃতিতে জিপিএইচের অবৈধ ও বেআইনী স্থাপনা প্রত্যাহার এবং জিপিএইচের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের নিকট আহবান জানানো হয় এবং এই উচ্ছেদ প্রক্রিয়া রোধ করারও দাবী জানানো হয়। এছাড়াও বিগত ১৯ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে কো-চেয়ার সুলতানা কামাল, এলসা স্টামাতোপৌলৌ ও মির্না কানিংহাম কেইন এর যৌথ স্বাক্ষরে Cittagong Hill Tracts Commission  এর পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম জেলার মাননীয় জেলা প্রশাসক বরাবর একটি দাবীনামা প্রেরণ করা হয় । উক্ত পত্রে পরিবারগুলোর নিরাপত্তাসহ স্ব স্ব ভিটায় বসবাস করার অধিকার নিশ্চিত করা, পরিবারগুলোর নামে সরকারি জমি বন্দোবস্ত প্রদান,  পরিবারগুলোর জন্য সবধরণের নাগরিক সুবিধা প্রদান এবং কোম্পনীর দখল প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানানো হয়। 

উপরোক্ত সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের দাবিগুলো থেকে একটি বিষয় পরিস্কার যে, সবাই ঐ নিপীড়িত ও অবহেলিত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য জরুরী ভিত্তিতে একটি স্থায়ী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন এবং পরিবেশের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে কারখানার সম্প্রসারণ প্রকল্পটি বন্ধেরও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। অর্থাৎ শুধু উদ্ভূত পরিস্থিতির সমাধান করে রাস্তা খুলে দিলে বা পুকুরে স্নান করতে দিলে সমস্যার পূর্ণ সমাধান হবে না। তার জন্য প্রয়োজন জায়গার স্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে সামগ্রীক নিরাপত্তা প্রদান, তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সকল ধরণের নাগরিক সুবিধা সুনিশ্চিত করে জীবনমান উর্দ্ধমূখী করণ এবং জনস্বার্থে বা পরিবেশের স্বার্থে কারখানার প্রকল্পটি বন্ধ করা। 

এখন প্রশ্ন হল এই অসহায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য এবং পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচানোর এমন গুরুদায়িত্বগুলো নেবে কে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সেটিই। হ্যাঁ ব্যক্তি উদ্যোগে তাঁদেরকে বিভিন্ন দিক থেকে সহযোগিতা প্রদান করা সম্ভব, কিন্তু সেটি স্থায়ী সমাধান হিসেবে কাজ করবে কি?  যদিও এমন সহযোগিতারও প্রয়োজন রয়েছে। অথবা এমন হুমকীর সম্মুখীন পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা অতীতে দেখেছি সীতাকুন্ডের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর অনেক প্রয়োজনে প্রশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, যা সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। এমনকি অনেক দুঃসংবাদের মাঝেও প্রশাসনের  সহযোগিতায় কিছু কিছু ভাল খবর আমাদেরকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতেও বেশ সাহস যুগিয়েছিল। যেমন, সমকালের মতো পত্রিকার শিরোনামে  যখন দেখি  ‘বদলে যাচ্ছে সেই ত্রিপুরাপল্লী’ তখন গর্ব হয় বাংলাদেশকে নিয়ে। দেশকে নিয়ে যেমন গর্ব করি তেমনি করে যেতে চাই সুদূর ভবিষ্যতেও। দেশের সরকার বা প্রশাসন যেন এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে সুলতানা মন্দির ত্রিপুরা পাড়ার অসহায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়ায়, যাতে তারা নিরাপত্তার সাথে নিজ নিজ বাস্তুভিটায় চিরদিনের জন্য স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে জীবনমান উন্নয়নের দিকে ধাবিত করতে পারে, এই সাধারণ ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষগুলোর যেন উচ্ছেদের আতঙ্কে দিন কাটাতে না হয় বরং স্বাধীন বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে যথাযথ মর্যাদার সহিত বেঁচে থাকতে পারে এই আশাবাদ ব্যক্ত করি । কারণ এই মানুষগুলো টিকে থাকলে পরিবেশ টিকে থাকবে, পরিবেশ টিকে থাকলে  গড়ে উঠবে একটি বাসযোগ্য সুন্দর বাংলাদেশ।

[বি.দ্র. লেখাটি তৎকালীন ঘটনার সমসাময়িক কালে লেখা । কিন্তু কোথাও ছাপা হয়নি বা  ব্লগেও পোস্ট করা হয়নি । তবে একটু দেরিতে হলেও  ব্লগে পোস্ট দিলাম।]

Post a Comment

0 Comments

এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও ব্যবহার বেআইনি