যেতে হবে বহুদূর যেখান থেকে স্বপ্নগুলো হাতছানি দেয়



মুকুল কান্তি ত্রিপুরা



নিয়মিত কোন লেখক নই। নই কোন বড় মাপের সাহিত্যিক। কিন্তু আমার স্বপ্নের কথার তাড়না সমলিয়ে উঠা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি, তাই দু’কলম লেখার প্রয়াস পেয়েছি আজ। স্বপ্নটি আজকের নয়, দেখছি অনেক বছর ধরে।  জীবনের এই প্রান্তে দাঁড়িয়েও হাল ছাড়ছিনা তবে। আমার এই স্বপ্নের জলে কখনো ভেসে উঠে সবুজ পাহাড়, ঝর্ণাধারা, নীলাভ হ্রদ আর বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র আবার কখনোবা এতসব সৌন্দর্যের মাঝে এগিয়ে যাওয়ার গল্প। সে যাই হোক, বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্রের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পাহাড়, পর্বত আর হ্রদে ঘেরা  ‘রাঙ্গামাটি’ নামক একটি প্রন্তিক জেলায় দাঁড়িয়ে না হয়  একটি স্বপ্ন দেখার প্রয়াস পেলাম আর কি। 

ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান এপিজে আবদুল কালাম একটি কথা বলেছিলেন- “স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। আর স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখ, স্বপ্ন হল সেটাই যা তোমাকে ঘুমাতে দেয় না।”  এপিজে আবদুল কালাম ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার পরিবর্তে মানুষকে জেগে স্বপ্ন দেখার  অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। যে স্বপ্ন একটি নিছক কল্পনামাত্র নয়  এ স্বপ্ন মানুষের গন্তব্য, যেখানে আমি যেতে চাই। অর্থাৎ বড় হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু আমার স্বপ্নটি আরেকটু অন্যধরণের স্বপ্ন যেখানে মানুষ শুধু নিজের বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখেনা আরেকজনকেও বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। 

আমরা জানি পার্বত্য চট্টগ্রাম সুদীর্ঘ সময়কাল থেকে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় অনেক পিছিয়ে। আর পিছিয়ে পরা বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পরা।  তাই আমি স্বপ্ন দেখি অত্র অঞ্চলের শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পরা শ্রেনির মানুষগুলোকে নিয়ে। তাঁরাও একদিন পড়ালেখা করবে ভাল ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জ্ঞানার্জন করবে উন্নত বিশে^র দেশগুলোতে  গিয়ে এবং আরেকজনকেও স্বপ্ন দেখাবে বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার। আমি স্বপ্ন দেখি, এই পার্বত্য চট্টগ্রামেরই রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত আমার রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের শিক্ষাথীরাও একদিন অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ ইত্যাদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা করবে। এ কলেজ থেকে বেরিয়ে দেশের ভাল ভাল বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে পড়াশোনা করবে এবং ভাল অবস্থানে যাবে।

এখন প্রশ্ন হল, কিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত হলো? যদি একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাই তাহলে সেটি বেশি অতীতের কথা নয় মাত্র প্রায় দেড়শত বছর আগের কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি গঠিত হয় ১৮৬০ সালে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামক জেলাটি প্রতিষ্ঠার পূর্বে জেলাটি চট্টগ্রাম জেলার অধীনস্থ একটি পাহাড়ী অঞ্চল ছিল।  জেলা গঠিত হওয়ার পর জেলার দপ্তর স্থাপন করা হয় কর্ণফুলী নদীর তীরে চন্দ্রঘোনা নামক স্থানে। যা বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত। ব্রিটিশরা পার্বত্য অঞ্চল শাসন করার পূর্ব পর্যন্ত কিরূপ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রচলিত ছিল অথবা আদৌ ছিল কিনা এই নিয়ে অনেক গবেষণার বিষয় রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম প্রথমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৬২ সালে এই চন্দ্রঘোনায়। Chittagong Hill Tracts District Gazetteer এ পার্বত্য চট্টগ্রামে শিক্ষার ইতিহাস সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে- ÒThe history of education in the district commences with the foundation of a boarding school at Chandraghona in October, 1862. At this school, elementary education was imparted to the hill boys. 
At a latter period the school was divided into Burmese class and Chakma class. In the former, Burmese, English and Bengali were taught and in the letter, English and Bengali only. In 1869, on account of the transfer of the district headquarters the school was transferred to Rangamati and renamed as Rangamati Government Boarding School. In 1873 the school was given the status of a Middle English School.”[Chittagong Hill Tracts District Gazetteer, 1971, p. 187]

এই বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি ব্যতীত চাকমা এবং মারমা ভাষাও শেখানো হতো। বিদ্যালয়ের নামটি ছিল ‘চন্দ্রঘোনা বোর্ডিং স্কুল’। স্কুলে আবাসিক সুবিধা ছিল। এটিই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম স্কুল। পরবর্তীকালে ১৮৬৮ সালের অক্টোবর মাসে জেলার সদর দপ্তর রাঙ্গমাটিতে স্থানান্তরিত করা হলে ১৮৬৯ সালে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙ্গামাটিতে স্থানান্তরিত করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘রাঙ্গামাটি সরকারী বোর্ডিং স্কুল’। পরবর্তীতে এই স্কুলটিকে গরফফষব ঊহমষরংয ঝপযড়ড়ষ এ উন্নীত করা হয় । আর ১৮৯০ সালে স্কুলটিকে হাই ইংলিশ স্কুলে উন্নীত করা হয়। অর্থাৎ একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়। ঈযরঃঃধমড়হম ঐরষষ ঞৎধপঃং উরংঃৎরপঃ এধুবঃঃববৎ এর ১৯৯ ও ২০০ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী ১৮৬০-১৯৭০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সময়কাল হল:  রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮৯১ সালে এবং স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৮৯৩ সালে, দিঘীনালা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৩১ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৬৫ সালে, পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বিশেষ শিক্ষাবোর্ড গঠিত হয়েছিল ১ এপ্রিল ১৯৩৮, রামগড় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৫১ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৫২ সালে কর্নফুলী প্রজেক্ট হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৫৩ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৫৪ সালে, রাঙ্গামাটি শাহ উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৫৭ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৫৮ সালে, খাগড়াছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বীকৃতি পায় ১৯৫৮ সালে, পোয়াপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৬৮ সালে, বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় একটি জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে এবং উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১-১-১৯৬৫ তারিখে, কর্ণফুলী পেপার মিল উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৩ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৬৪ সালে, রাঙ্গামাটি কলেজ প্রথমে একটি প্রাইভেত কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে এবং চৎড়ারহপরধষরুবফ হয়েছিল ১৯৭০ সালের মে মাসে, কাসালং উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে, রাঙ্গামাটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে, পানছড়ি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৭ সালে এবং স্বীকৃতি পায় ১৯৬৮ সালে। এগুলো ব্রিটিশ ও পাকিস্তান শাসনামলের কথা। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর পার্বত্যাঞ্চলে আরো অনেকগুলো শিক্ষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল যেগুলো পার্বত্যাঞ্চলের শিক্ষাবিস্তারের কার্যক্রমকে আরো বেগবান করেছে। যেমন আমার জানামতে শুধুমাত্র রাঙ্গামাটি জেলায় বর্তমানে কলেজের সংখ্যা প্রায় ২০ টি। যদিও রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজটি প্রতিষ্ঠার সময় এতগুলো কলেজ ছিল না। এতগুলো কলেজ প্রতিষ্ঠার পরও রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা প্রয়োজন। 

২০১৪ সালের ১১ মে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজটি। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে যাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় তিনি হলেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার তৎকালীন মাননীয় জেলা প্রশাসক ও কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব মোঃ মোস্তফা কামাল মহোদয়। যিনি বর্তমানে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, তিনি এমনই এক সময়ে কলেজটি প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিয়েছিলেন যে বছরে চট্টগ্রাম বোর্ডের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৯১.৪০ শতাংশ। অর্থাৎ পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনাই ঐ বছর চট্টগ্রাম বোর্ডের পাশের হার ছিল অনেক বেশি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ফলাফলগুলো এক পলক অবলোকন করলে বোঝা যাবে যে, প্রতিবছর পাসের হার উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। সুতরাং রাঙ্গামাটি জেলা শহরে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ ও রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ ব্যতীত কলেজ পর্যায়ে আর কোন প্রতিষ্ঠান না থাকায় ক্রমবর্ধমান পাস করা এই শিক্ষার্থীদের ভর্তিও জন্য কলেজ পর্যায়ে একটি নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কেননা ঐ দুই কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়ায় জিপিএ এর পরিমাণ  নির্ধারণ করে দেওয়া হতো এবং আসন সংখ্যৃা ছিল সীমিত। তাছাড়া  বর্তমানে জেলা শহরে রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের পর লেকার্স পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখা খোলা হলেও ২০১৪ সালে সেখানে কলেজ পর্যায়ে ভর্তির সুযোগ ছিলনা।  অপরদিকে ২০১৪ সালের চট্টগ্রাম বোর্ডের ফলাফল ছিল রেকর্ড সংখ্যক। এই রেকর্ড সংখ্যক ফলাফলে শিক্ষার্থীর পাসের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির জন্য কলেজে আসনের চাহিদাও সমভাবে বৃদ্ধি পায়। এরূপ পরিস্থিতিতে রাঙ্গামাটি জেলা শহরে ‘রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজ’ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ছিল খুবই সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। কেননা রাঙ্গামাটি জেলায় জেলা শহরে এসে পড়ালেখার স্বপ্ন যারা দেখে তারা যদি কোন কারণে রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ বা রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজে গিয়ে ভর্তির সুযোগ না পায় তাহলে তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার অন্যতম আশ্রয় হিসেবে সমর্থন যোগায়।

কিভাবে প্রতিষ্ঠা হলো রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজ ? এ বিষয়ে একটু আলোচনা করা যাক। এই কলেজ অত্র জেলার গণমানুষের দীর্ঘ দিনের চাহিদার একটি প্রতিষ্ঠান যা বর্তমানে অত্র এলাকায় মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। অত্র অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই মূলত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা প্রশাসনের এই মহতি উদ্যোগ। 
কলেজটি ২০১৪ সালের ১১ মে তৎকালীন মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ মোস্তফা কামাল মহোদয়ের উদ্যোগে অত্র এলাকার শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সহযোগীতায় একটি বেসরকারী কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যা রাঙ্গামাটি জেলা শহরের আসামবস্তির নরিকেল বাগানের পাশে ৩.০০ একর ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যার উত্তর-দক্ষিণে কাপ্তাই লেক ও রয়েছে মনোরম পরিবেশ।

বিগত ১১ মে, ২০১৪ খ্রি. তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জনাব বীর বাহাদুর উশৈচিং মহোদয় (বর্তমানে উক্ত মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী জনাব দীপংকর তালুকদার মহোদয় (বর্তমানে ২৯৯ পার্বত্য রাঙ্গামাটি আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য), তৎকালীন মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব ফিরোজা বেগম চিনু মহোদয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মাননীয় সচিব জনাব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা এনডিসি মহোদয় (বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর মাননীয় চেয়ারম্যান), রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের তৎকালীন মাননীয় চেয়ারম্যান জনাব নিখিল কুমার চাকমা,  তৎকালীন মাননীয় জেলা পুলিশ সুপার জনাব আমেনা বেগম প্রমুখসহ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার শিক্ষানুরাগী গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে কলেজটির শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। 

আমার চাকুরী জীবনের শুরুটা এই প্রতিষ্ঠানে এবং এখনো আছি। সেই সুবাধে বিগত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে কলেজের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। দেখেছি একটি কলেজ কিভাবে শুরু হয় এবং বেসরকারীভাবে গড়ে উঠা কলেজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কি পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয়? তবে কাছ থেকে দেখেছি একজন মানুষকে, যিনি পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কি পরিমাণ কষ্টই না করেছেন। কখনো যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য নৌকা প্রদান, কখনো পোষাক প্রদান, কখনো কলেজ প্রতিষ্ঠা আবার কখনোবা ইংরেজি ভার্সনের স্কুল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিই ছিল তাঁর পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার এক একটি পদক্ষেপ। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের জন্মদাতা, অভিভাবক রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার তৎকালীন মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ মোস্তফা কামাল স্যার। তিনি ছিলেন একটি স্বপ্ন, একটি অনুপ্রেরণা ও একটি আশ্রয়। তাঁর সময়কালে অনেক অনুষ্ঠান হতো কলেজে। তাঁর বাগ্মিতা ছিল অসাধারণ । তিনিই আমাদের নিয়োগদাতা। এককথায় তিনি ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি রাঙ্গামাটিতে মাননীয় জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিলেন ২৭-০৫-২০১২ খ্রি. তারিখ থেকে ২৪-১২-২০১৪ খ্রি. তারিখ পর্যন্ত। কলেজ প্রতিষ্ঠার পর তিনি মাত্র ছয়মাস ছিলেন দায়িত্বে। তাঁর সময়কালে এডিসি(রেভিনিউ) হিসেবে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান স্যার,  সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ছিলেন ইবনুল স্যার, সাব্বির স্যার, রেজা স্যার, প্রসুন স্যার সহ আরো অনেকেই যাঁরা এই কলেজের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। আরো পরিশ্রম করেছেন অফিসের কর্মচারীবৃন্দ। সত্যি কৃতজ্ঞতার ভাষা হারিয়ে ফেলি যখন তাঁদের কথা মনে পড়ে। কি না করেছেন কলেজের জন্য। শিক্ষকতা জীবনের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে পাই আমাদের সকলের খুবই প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন সুযোগ্য অধ্যক্ষ জনাব তাছাদ্দিক হোসেন কবীর স্যারকে। তিনি শুধু আমাদের প্রতিষ্ঠান প্রধানই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন দায়িত্ববান অভিভাবক। সহকর্মী হিসেবে পেলাম অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মুবিন স্যার, রেনী ম্যাডাম, মহসিনা ম্যাডাম, রেখসনা ম্যাডাম, পারিকা ম্যাডাম, কাউছার স্যার, তোষলী ম্যাডাম, শর্মী ম্যাডাম ও রহিমা ম্যাডামকে। অত্যন্ত ভাল মনের মানুষ তাঁরা। আসলে পুরো পাবলিক কলেজ যেন একটি পরিবার। একজন আরেকজনের সাথে সুমধুর সম্পর্ক দেখলে মনে হয় যেন অনেক বছর ধরে চেনা। পরের বছর সুজা স্যারের যোগদান শিক্ষক পরিবারে আরো নতুন মাত্রা যোগ করে।  ভাল কর্মচারী হিসেবে পেয়েছি সৌমিত্রকে, উজ্জল, মাহাবুবকে। পরবর্তীতে যোগ দেয় জয়নাল, হাকিম, নাজমা, শরীয়ত ও ড্রাইভার হিসেবে জামাল সাহেব। 

কলেজের ভর্তির কার্যক্রম জুন মাসে সমাপ্ত হলে ২০১৪-২০১৫ শিক্ষাবর্ষের মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে মোট ২৭৮ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাডেমিক কার্যক্রমের শুভ সূচনা হয় ০৭ আগস্ট, ২০১৪ খ্রি. তারিখে কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাস রাঙ্গামাটি শহরের তবলছড়িস্থ জেলা প্রশাসন কর্তৃক অধিগ্রহণকৃত মিনিস্ট্রিয়াল ক্লাবে।[একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ অসমাপ্ত হওয়ায় বর্তমানে অস্থায়ী ক্যাম্পাসেই পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে] একটা বিষয় খুবই লক্ষনীয় যে, কলেজের নিজস্ব কোন ভবন ছিলনা, পাঠদান অনুমতি ছিল না এমনকি ছিলনা ভূমির বন্দোবস্ত অথচ এক নিমেষেই ২৭৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে গেল। কি পরিমান বিশ^াস ছিল তাদের? হয়তোবা প্রয়োজনটা ছিল অনেক বেশি। অতঃপর ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ খ্রি. তারিখে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩.০০ একর ভূমি রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের নামে বন্দোবস্ত করে দেয় এবং ঐ মাসের ২২  তারিখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠদানের অনুমতি প্রদান করলে কলেজ বৈধভাবে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ পায়।  শুরুতে জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে ১ টি কম্পউটার, ২ টি লেপটপ ১ টি প্রিন্টার ও মাল্টিমিডিয়া হস্তান্তর কলেজের অগ্রগতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা যোগ করে। শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ জেলা প্রশাসন ও রাঙ্গামাটি কাঠব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লি: প্রতিমাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে কলেজের অগ্রগতিকে আরো বেগবান করে । পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড একাডেমিক ভবন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন মাননীয় সচিব জনাব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা এনডিসি মহোদয় ২১ নভেম্বর, ২০১৪ খ্রি. তারিখে একাডেমিক ভবন নির্মাণের শুভ উদ্বোধন করেন। ফলে এগিয়ে যায় কলেজটির একাডেমিক ভবন নির্মাণ কার্যক্রম। কিন্তু হঠাৎ মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ মোস্তফা কামাল স্যারের বদলির সংবাদটি শিক্ষকমন্ডলী তথা গোটা কলেজ পরিবারকে ব্যাথিত করে। কেননা কলেজটি সবইমাত্র জন্ম হয়েছে, আর সবকিছু গুছিয়ে উঠার আগেই এমন দুসংবাদ কউ মেনে নিতে পারছিলেননা। তিনি ২৪ ডিসেম্বর দায়িত্ব হস্তান্তর করে চলে যান খুলনার জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে আর নতুন মাননীয় জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জনাব মো: সামসুল আরেফিন স্যার। কলেজে পুনরায় ফিরে আসে প্রাণোচ্ছল পরিবেশ। তাঁর সময়কালে জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে আরো ২ টি কম্পউটার, মাল্টিমিডিয়া, কালার প্রিন্টার, স্ক্যানার, ফটোকপিয়ার হস্তান্তর এবং শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব ও ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হলে আরেক ধাপ এগিয়ে যায় কলেজটি। ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪ খ্রি. তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড চট্টগ্রাম কর্তৃক পাঠদানের অনুমোদন পায় কলেজটি। আর ২০১৬ সালের এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় ৬৪.৬৬% পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলে সফলতার মুখ দেখতে পায় কলেজটি। ২৫ জুন, ২০১৬ খ্রি. তারিখে মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজকে ছাত্র-ছাত্রীর যাতায়াতের সুবিধার জন্য একটি বাস হস্তান্তর কলেজের শিক্ষা কার্যক্রমে আরো নতুন মাত্রা যোগ করে। তখন শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার বৃদ্ধি পায়। যেইনা কলেজটি একটু গুছিয়ে নিচ্ছে ঠিক তখনই আবার ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেজে উঠল জেলা প্রশাসক মহোদয়ের বিদায়ী ঘন্টা। আবারো মেনে নিতে হলো মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব মো: সামসুল আরেফিন মহোদয়ের বিদায়। তিনি ২২ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব হস্তান্তর করেন এবং নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে জনাব মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান স্যারে দায়িত্ব গ্রহণে পুনরায় অভিভাবক ফিরে পায় কলেজটি। চলে আসে স্বস্তি সবার মনে। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কলেজের সার্বিক বিষয়ের খোজ খবর নিয়ে কলেজটিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সহযোগীতা করে গেছেন । তিনি সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দের মাসিক বেতন বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের মাঝে কর্মস্পৃহা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন।  এরপর তিনি চলে গেলে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বর্তমান সুযোগ্য মাননীয় জেলা প্রশাসক জনাব এ কে এম মামুনুর রশীদ মহোদয়। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা প্রদানসহ সার্বিক দিক নজর রেখে কলেজের অগ্রগতিতে বেশ অবদান রেখে যাচ্ছেন। তিনিই কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাসে সেমিপাকা টিনশেড ভবন নির্মানের কাজটি শুরু করেছিলেন যা বর্তমানে চলমান রয়েছে। 

একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে অনেক শ্রম, মেধা, অর্থ , সুস্থ ব্যবস্থাপনা ও এলাকার জনগণের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যার প্রত্যেকটিই অত্র কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেছিল। পর্যাপ্ত শিক্ষক ও পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীও রয়েছে কলেজে। কিন্তু তবুও যে পরিমাণ সাফল্য নিয়ে কলেজটি এগিয়ে যাওয়ার কথা কলেজ সে পরিমাণ এগিয়ে যেতে পারেনি। তার প্রধান অন্তরায় হিসেবে আমি মনে করি একাডেমিক ভবন নির্মানে মামলা সংক্রান্ত জটিলতা। কেননা মামলার জাটিলতার কারণে স্থায়ী ক্যাম্পাসে কলেজের একাডেমিক ভবন নির্মানকাজ সম্পন্ন না হওয়ায় শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা থেকে শুরু করে একটি কলেজে শিক্ষার্থী যে যে সুবিধা পাওয়ার কথা সেগুলো পাচ্ছে না। কিন্তু কলেজ কতৃপক্ষ নিরূপায় বিধায় অস্থায়ীভাবে এখনো অধিগ্রহণকৃত তবলছড়িস্থ মিনিস্ট্রিয়াল ক্লাবে শ্রেণিকার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হচ্ছে। যাহোক, সেই জায়গাতে যতটুকু সম্ভব সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শ্রেণিকার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কলেজের উপরোক্ত বিষয়গুলো আলোচনার মুখ্য উদ্দেশ্য শুধুই অনুভূতি প্রকাশ করা নয় বরং রাঙ্গামাটিতে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা এবং কলেজ প্রতিষ্ঠায় কিছু অন্তরায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করাও অন্যতম উদ্দেশ্য। আমার অত্র কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পূর্ব থেকেই একটি স্বপ্ন সবসময় তাড়না করতো। আর সেটি হল পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষা বিস্তারে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা এবং অন্যকেও সম্পৃক্ত করে এই  শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যপক ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসা। আর কলেজে যোগদানের পর আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি। পার্বত্য চট্টগ্রাম শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার কারণটা কী এবং এই পিছিয়ে থাকা থেকে মুক্তি পেতে হলে কী কী করা প্রয়োজন ? সেগুলো আমার ছাত্রজীবন ও শিক্ষক জীবন থেকে প্র্যাক্টিক্যাল কিছু বিষয় অনুধাবন করে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি। প্রথমত, স্মরণাতীতকাল থেকে এ অঞ্চল ছিল জঙ্গলাকীর্ন একটি অঞ্চল। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত হয়নি এ অঞ্চলের। একটি কথা দিবালোকের মতো পরিস্কার যে, যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি ভাল না হয় তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত তারা কিভাবে সময়মত পৌঁছাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সহজভাবে গ্রহণ করবে? দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপ্রতুলতা। পার্বত্য অঞ্চলের অনেক এলাকায় এখনো স্কুল নেই। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে অনেক দূর দূরান্তে যেতে হয় ঐ এলাকার শিক্ষার্থীদের। অন্যদিকে অভিভাবকদের অসচেতনতা এবং আর্থিক বাস্তবতাতো আছেই। যেমন-  একদিন একজন শিক্ষার্থীকে কলেজে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি এতদিন কলেজে আসোনি কেন? সহজভাবে জবাবে বলল, স্যার বাড়িতে কাজ করতে হয়েছে তাই আসতে পারিনি। তার কাছে কলেজে আসতে না পারাটা খুব কষ্টের কিছু না কারণ তার পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাকে আসতে দেয়নি। এসব কিছুর পেছনে আমি কাউকে দায়ী করবনা । শুধুই দরকার একটি সমন্বয়। একটি সমন্বিত উদ্যোগ পারে এসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে, পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে সর্বোপরি পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে। আবার শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেই হবে না। দরকার পর্যাপ্ত দায়িত্বশীল যোগ্য শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত তদারকি করা । পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল সুদীর্ঘকাল ধরে বিভিন্ন দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় অত্র অঞ্চলে গড়ে উঠেনি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু অত্র অঞ্চলের শিক্ষর্থীদের আধুনিক শিক্ষা  গ্রহণের আকাক্সক্ষা ফুরিয়ে যায়নি। তাই তারা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার স্বপ্নকে লালন পালন করেছে স্মরণাতীতকাল থেকে। আর এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন সকল শ্রেণিপেশার মানুষের সর্বাত্মক সহযোগীতা ।

আমাদের কলেজে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় পয়েন্ট কম নিয়ে। কেননা রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ এবং রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ এই দুই কলেজে কেই যদি ভর্তির সুযোগ না পায় তখনই তারা আমাদের কলেজে ছুটে আসে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও হয়। আর যাই হোক হতাশা অথবা হীনমন্যতা মানুষকে কখনো বড় করে না বরং পিছিয়ে যেতে সাহায্য করে। যে যত পয়েন্ট নিয়ে ভর্তি হোক না কেন, মানসিক শক্তি থাকলে সম্ভব সেখান থেকেও ভাল ফলাফল করা। তবে হ্যাঁ স্বপ্নটা একটু বড় করেই দেখতে হবে। যেভাবে হোক ভাল রেজাল্ট করতেই হবে। অত্র কলেজের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রী পারিবারিকভাবে আর্থিক সাপোর্ট ছাড়াই পড়ালেখা করছে। কেউ রাঙ্গামাটি জেলা শহরের রেস্টুরেন্ট এ, কেউবা গেরেজে, কেউবা কোন এক দোকানে চাকুরী, আবার কেউবা মা-বাবার সাথে জুমচাষের সময় জুমে কাজ করতে হতো।  এভাবে পরিবেশ পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে তাঁদের শ্রেণিকার্যক্রমে অংশগ্রহণ কিছুটা সহজ করে দেওয়া হয়। কেননা তাদেরকে যদি এমন সুযোগ প্রদান করা না হতো তাহলে তারা কাজ করে হলেও পড়ালেখার সুযোগ পেত না। এখন কথা হলো, জীবন কি ঐ কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থেমে থাকবে? না, থামবে না। যদি সে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে সে অবশ্যই বড় হবে কোন একদিন। এখানে আমি উদাহরণ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য কলেজের মতো আমার কলেজটাকে উপস্থাপন করলাম মাত্র। 

আমার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথাতো বলতেই হয়। যদি কখনো মনে হয় জীবনটা থেমে গেছে, মনে রাখবে ঠিক তখনই স্বপ্নের  বাসা বাঁধা শুরু। আর যদি কখনো মনে হয় স্বপ্ন থেমে গেছে মনে রাখবে ঠিক তখনই জীবনটার গতি শুরু।  জীবনযুদ্ধের ময়দানে নামলে কখনো বিজয়ীর বেশে আবার কখনোবা পরাজিতের বেশে আসতে হয়। দুটোকে মেনে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। কিন্তু স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেওয়া যাবে না। কথায় আছে- “হাল ছেড়োনা বন্ধু”। যত বাধা-বিপত্তিই আসুক না কেন লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে। তাহলে কোন না কোন সময় একদিন ঠিকই পৌঁছে যাবে তার গন্তব্যে। তবে মনের কোণে শুধু স্বপ্ন আঁকলেই হবে না। প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ। জ্ঞানই তোমাকে মহান করবে। জ্ঞান তোমাকে সফলতার দ্বারে ঠেলে নিয়ে যাবে। কাজ করার সময় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা এসে হাজির হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে কোন প্রতিবন্ধকতা যেন কোনোভাবেই তোমাকে প্রভাবিত করতে না পারে। প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে উপেক্ষা করবে না বরং মোকাবেলা করার চেষ্টা করবে। আরেকটি বিষয়, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কাজের ক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। স্বপ্ন যদি পূরণ করতে চাও, তোমার যত শক্তি তার সবটুকু প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সফলদের একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্নের পেছনেই তারা ছুটে চলে। আগে থেকেই তারা প্রস্তুত থাকে যেকোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য। ব্যর্থ হলে তারা ভেঙে পড়ে না। বরং নতুন উদ্যমে কাজ করে যায়। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যায় তারা । এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব আসে। এভাবেই সত্যি হয় স্বপ্ন। শুধু নিজের জন্য নয়। ভাবতে হবে পরিবারের জন্য। যে পরিবার একটি নিরীহ শিশু থেকে তোমাকে আজকের তুমি করে তোলেছে । ভাবতে হবে সমাজের কথা। যে সমাজ তোমাকে, তোমার পরিবারকে বিভিন্ন দিক থেকে সহযোগিতা করে আসছে। ভাবতে হবে দেশের কথা যে দেশ তোমাকে বেঁচে থাকার সমস্ত সুযোগ করে দিয়েছে। সর্বোপরি ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যাঁরা যুগের পর যুগ বাঁচিয়ে রাখবে তোমাকে, তোমার পরিবারকে, তোমার দেশকে এমনকি পুরো বিশ^কে। তাই এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর যেখান থেকে স্বপ্নগুলো হাতছানি দেয় বারংবার। 


লেখক: প্রভাষক, ইতিহাস, রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজ।

[লেখাটি বিগত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রি. তারিখে রাঙ্গামাটি পাবলিক কলেজের প্রথম পুনর্মিলনী ২০১৯ এর স্মরণিকার ২২-২৭ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়]

Post a Comment

0 Comments

এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও ব্যবহার বেআইনি