নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকা মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া


উনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন । যেসময়ে এদেশের সমাজব্যবস্থায় অশিক্ষা, কুশিক্ষা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল ঠিক সে সময়ে অচেতন নারীর মধ্যে অধিকারবোধ জাগানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাদের শিক্ষার আলোকে অবগাহন করানোর ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, আত্মমর্যাদা জাগরণের প্রেরণা হয়েছিলেন তিনি সমস্ত রকম পিছুটানহীন রোকেয়া নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করেছিলেন সামাজিক কুসংস্কার থেকে নারী সমাজকে মুক্ত করার কর্মযজ্ঞে

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায় তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া তাঁর বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদেরকে ঘরে আরবী উর্দু শেখানো হয় তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনস্ক ছিলেন তিনি রোকেয়া করিমুননেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ইংরেজি শেখান

১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভারতের বিহারের ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী বিপত্মীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বেগম রোকেয়া বিয়ের পর তিনিবেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেননামে পরিচিত হন তাঁর স্বামী মুক্তমনা মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন স্বামীর উৎসাহ প্রেরণায় বাংলা ইংরেজী উত্তমরুপে আয়ত্ত করেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেনরোকেয়ার মতো সৈয়দ সাখাওয়াতও চেয়েছিলেন নারীর মুক্তি, নারী সমাজে শিক্ষা বিস্তার তথা নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন অল্প বয়সেই স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় বেগম রোকেয়া সম্পূর্ণ একা  হয়ে পড়েন  সময় তিনি সমাজসেবা সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন সৈয়দ সাখাওয়াত হেসেনের মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালের ১ অক্টোবর স্বামীর জন্মস্থান ভাগলপুরে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নামে  মেয়েদের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার ফলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ১৯১১ সালের ১৫ই মার্চ তিনিসাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ পুনরায় চালু করেন প্রাথমিক অবস্থায় এখানে ছাত্রী ছিল মাত্র জন চার বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে ১৯৩০ সালের মাঝে এটি হাইস্কুলে পরিণত হয় স্কুল পরিচালনা সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখেন

১৯১৬ সালে বেগম রোকেয়া বিধবা নারীদের কর্মসংস্থান, দরিদ্র অসহায় বালিকাদের শিক্ষা, বিয়ের ব্যবস্থা, দুস্থ মহিলাদের কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ, নিরক্ষরদের অক্ষর জ্ঞানদান, বস্তিবাসী মহিলাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম মুসলিম মহিলা সমিতি আন্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম তৎকালীন বাংলার পশ্চাৎপদ অবহেলিত মুসলিম নারীদের গৃহকোণের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য এবং নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে নারী উন্নয়নের ইতিহাসে এই সমিতির অবদান অপরিসীম বিভিন্ন সভায় তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন  ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন

নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য তিনি তার লেখনীর মধ্য দিয়ে সংগ্রাম চালিয়েছেন নারী সমাজ পুরো সমাজকে সচেতন করার জন্য তিনি বলেছেন, “আদিম কালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে তবু মনে হয়, পুরাকালে সভ্যতা ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এইরূপ ছিল না কোনো অজ্ঞাত কারণবশত মানব জাতির এক অংশ (নর) নানা বিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সাথে সাথে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল১৯০২ সালে `পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা Sultana’s Dream১৯০৫ সালে বেগম রোকেয়া ইংরেজিতে Sultana’s Dream লেখা শেষ করেন সাখাওয়াত হোসেন লেখাটি পড়ে অভিভূত হন এবং লেখাটি প্রকাশের জন্য রোকেয়াকে উৎসাহিত করেন ১৯০৮ সালে ‘Sultana’s Dream’ বই আকারে প্রকাশ হয় পরবর্তীতে বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয়যার অনূদিত রূপের নাম `সুলতানার স্বপ্ন’ এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয় তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হলঃ পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ হল বাসিফু, শশধর, নলিনী কুমুদ কাঞ্চনজঙ্গা, আপীল, চাঁদ ইত্যাদিতাঁর প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেনধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারীর মুক্তি আসবে নাতা বলেছেন

বাংলার নারীজাগরণের প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা বেগম রোকেয়ার জীবনদীপ নির্বাপিত হয় ১৯৩২ সালের ডিসেম্বর শুক্রবার ঊষালগ্নে ডিসেম্বর রাত এগারোটা পর্যন্ত তিনি নিমগ্ন ছিলেন লেখাপড়ায় সেসময় তিনি নারীর অধিকার নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন ইহজীবনে সব অবহেলাকে হেলায় জয় করেছিলেন রোকেয়া মৃত্যুতেও আপন সৃষ্টির মাঝেই তিনি অমলিন এমন মানুষ কোনদিন মরে না, তাঁর কর্মপ্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে কোটি কোটি মানুষের মনে প্রাণে বিস্তর জায়গা নিয়ে বেঁচে আছে সারাজীবন তাঁর সংগ্রামী মনোভাব প্রজন্মের নারী শিক্ষা আন্দোলনের কর্মীদের জন্য পথচলার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে

Post a Comment

0 Comments

এই ওয়েবসাইটের লেখা, ছবি, ভিডিও ব্যবহার বেআইনি